ইউনূস-হাসিনার বিরোধ কবে থেকে
দেশের জনগণের মনে ভুল ধারণা রয়েছে যে প্রফেসর ইউনূস ২০০৭ সালে রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যর্থ প্রয়াস চালানোয় এবং সামরিক বাহিনীর ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র পেছনে তাঁর ভূমিকা রয়েছে বলে ধরে নিয়ে হাসিনা তাঁর প্রতি শত্রু মনোভাবাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু আসলে প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে হাসিনার প্রচণ্ড আক্রোশ ও উৎপীড়ন-মনোবৃত্তি শুরু হয়েছিল ১৯৯৭ থেকে। ১৯৫৮ সাল থেকে প্রফেসর ইউনূসের স্নেহভাজন অনুজপ্রতিম ব্যক্তি হিসেবে আমি সত্য ঘটনা জানি। কিন্তু আমার সহপাঠী-বন্ধু ‘দি ডেইলি স্টারের’ সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম ২০১০ সালে এই অংশটুকু বাদ দিয়ে ইউনূস-সম্পর্কীয় আমার কলাম প্রকাশ করেছিল, তার অপারগতার জন্য সে দুঃখ প্রকাশ করেছিল। বক্ষ্যমাণ কলামে আমি সত্যটুকু জাতিকে জানাতে চাই। ৫ আগস্ট যেহেতু ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণভয়ে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে, তাই এখন আশা করি সত্য কথাগুলো প্রকাশে আর বাধা থাকবে না।
১৯৯৭ সালে কীভাবে দুজনার সম্পর্কটি নষ্ট হতে শুরু করেছিল, সে কাহিনিটি আমি শুনেছি খোদ প্রফেসর ইউনূসের বয়ানে ১৯৯৯ সালে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা এবং প্রফেসর ইউনূসের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। শেখ হাসিনা তখন ছিলেন প্রফেসর ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ মডেলের বড়সড় ভক্ত। ১৯৯৬ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি মাত্র বৈঠকে চা-নাশতা খাইয়ে অত্যন্ত আগ্রহভরে প্রফেসর ইউনূসকে গ্রামীণফোনের লাইসেন্সটি দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি প্রফেসর ইউনূসকে রেলওয়ের আন্ডারগ্রাউন্ড-কেব্ল নেটওয়ার্কটি নামমাত্র ফির বিনিময়ে ব্যবহার করতে দেওয়ায় গ্রামীণফোন স্বল্প-খরচে সারা দেশে তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘ওয়ার্ল্ড মাইক্রো-ক্রেডিট সামিটে’ প্রফেসর ইউনূস শেখ হাসিনাকে উদ্বোধকের বিরল সম্মানটি দিয়েছিলেন। সামিটের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন স্পেনের রানি সোফিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী ‘যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি’ হিলারি ক্লিনটন। তাই সামিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও উপস্থিত ছিলেন। (প্রফেসর ইউনূস ক্লিনটন দম্পতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আশির দশক থেকেই, যখন বিল ক্লিনটন আরকানসাস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গরিব অঙ্গরাজ্য আরকানসাসে প্রফেসর ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ মডেলটি সফলভাবে চালু করেছিলেন গভর্নর বিল ক্লিনটন। তিনি তখন থেকেই প্রফেসর ইউনূসের বড়সড় ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সুযোগ পেলেই তিনি বলতেন, ‘ইউনূস শুড গেট নোবেল প্রাইজ ফর দিজ’)। সামিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর কফি-ব্রেকে আলাপ-আলোচনার একপর্যায়ে বিল ক্লিনটন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নাকি ওপরের কথাটি বলার পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে শেখ হাসিনা বিল ক্লিনটনকে বলেছিলেন, ‘ইউ নো মি. প্রেসিডেন্ট, মাই ফাদার ওয়াজ দি ফার্স্ট পারসন হু ইন্ট্রোডিউজড মাইক্রোক্রেডিট।’ বলা বাহুল্য, প্রফেসর ইউনূসের মডেলটি বিশ্বে বহুল-পরিচিতি পাওয়ার আগে ‘মাইক্রোক্রেডিট’ টার্মটি উন্নয়ন-চিন্তায় চালুই হয়নি। তাই শেখ হাসিনার কথা শুনে বিল ক্লিনটনসহ উপস্থিত সবাই চুপ মেরে গিয়েছিলেন। মনে মনে শেখ হাসিনা হয়তো ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এহেন নীরবতায়। কিন্তু ওই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা আর নাকি এগোয়নি।
এর পরের ঘটনাটিও প্রফেসর ইউনূস থেকেই শুনেছিলাম। ১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন সস্ত্রীক এসেছিলেন বাংলাদেশে। হয়তো অনেকেরই মনে আছে, ওই সফরের সময় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের নিরাপত্তার ইস্যুতে তাঁদের বাংলাদেশের গ্রামে নিয়ে যাওয়ার প্রোগ্রামটি বাতিল করা হয়েছিল। এর পরিবর্তে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে তাদের কার্যকলাপের একটি প্রদর্শনী দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রদর্শনী শেষ করে যখন সবাই কফি-ব্রেকে গিয়েছিলেন, তখন কফি খেতে খেতে হঠাৎ প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন আবার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ইউনূস শুড গেট নোবেল প্রাইজ ফর দিজ।’ এবার নাকি শেখ হাসিনা উত্তরে বলেছিলেন, ‘ইউ নো মি. প্রেসিডেন্ট, দি বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট শুড গেট নোবেল পিস প্রাইজ, বিকজ উই হ্যাভ রিসেন্টলি সাইনড দি হিস্টরিক চিটাগং হিল ট্র্যাক্টস পিস ট্রিটি উইথ দি শান্তি বাহিনী।’ ঘটনায় নাকি আবার সবাই হকচকিয়ে নীরব হয়ে রইলেন। কিন্তু এবার শেখ হাসিনা তাঁর রাগ লুকাতে পারলেন না। তাঁর পাশে থাকা এক দলীয় নেতা কিংবা আমলাকে তিনি নাকি কিছুটা উচ্চ স্বরে বলে উঠেছিলেন, ‘ইনাকে সাইজ করতে হবে।’ উচ্চ স্বরে বলায় আশপাশের অনেকেই কথাটি শুনে ফেলেছিলেন। অতএব, অতিদ্রুত ঢাকার নাগরিক সমাজে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন ডেপুটেশনে কর্মরত ছিলাম বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক হিসেবে, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত প্রফেসর মুজাফফর আহমদ ছিলেন বিআইবিএমের বোর্ড অব ডাইরেক্টরসের সদস্য। ঘটনার দু-তিন দিন পর তিনি আমার অফিসে এসে আমাকে বললেন, ‘মইনুল, তুমি তো ইউনূসের খুব ক্লোজ। ওকে জিজ্ঞেস কোরো তো প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁর কী হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী নাকি “ইনাকে সাইজ করতে হবে” বলে মন্তব্য করেছেন।’ সঙ্গে সঙ্গে আমি টেলিফোন তুলে প্রফেসর ইউনূসকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেজো ভাই, আপনাকে প্রধানমন্ত্রী “ইনাকে সাইজ করতে হবে” বলে শাসিয়েছেন কেন?’ (তাঁর ছোট ভাই আইউব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে প্রফেসর ইউনূসকে মেজো ভাই ডাকে, তাই আমিও তাঁকে মেজো ভাই ডাকি)। উনি বললেন, ‘তুমি কার কাছে শুনলে?’ আমি প্রফেসর মুজাফফরের কথা বলায় তিনি ওপরের দুটো ঘটনাই টেলিফোনে আমাকে জানিয়ে বললেন, ‘আমার কী দোষ ছিল এই দুটো ঘটনায়?’
ঘটনা ওখানেই থেমে থাকল না। ব্যক্তিগত একটি কারণে প্রফেসর ইউনূসের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তদানীন্তন গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন। সুযোগ বুঝে শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি অডিট টিম পাঠিয়ে দিলেন গ্রামীণ ব্যাংকে, যে টিম ২৭টি অডিট আপত্তি পেয়ে গেল গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে। ওই অডিট রিপোর্টের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আপত্তি ছিল প্রফেসর ইউনূসের বয়স ৬০ বছর পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁর দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে। (ওই অডিট রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রফেসর ইউনূস অবসর নিতে চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের তখনকার চেয়ারম্যান প্রফেসর রেহমান সোবহান তাঁকে নিবৃত্ত করেছিলেন এই বলে ‘এটা তোমার জন্য প্রযোজ্য নয়, তুমি তো গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা।’ পরবর্তী চেয়ারম্যান প্রয়াত ড. আকবর আলি খানও নাকি একই কথা বলেছিলেন)।
আপত্তিগুলো নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে আলোচনা শুরুর পর কিছুদিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা হারায়। বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়েছিলেন ড. ফখরুদ্দীন। অল্পদিনের মধ্যে সব আপত্তির নিষ্পত্তি হয়ে গেল। ২০০৬ সালে প্রফেসর ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেলেন। এরপর এসেছিল ২০০৭ সালের ঘটনাগুলো। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে এসেই আবার বয়সের ব্যাপারটা উত্থাপন করলেন। এবার ড. ফরাসউদ্দিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত কারণে জুটে গেলেন গ্রামীণ ব্যাংকের দুজন সাবেক উচ্চপদধারী ব্যক্তিত্ব দীপাল বড়ুয়া ও মোজাম্মেল হক, অ্যাডভোকেট তৌফিক নেওয়াজ এবং সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান।