
ক্ষমতার ভারসাম্যও দরকার
গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হন। এর ৩ দিন পর ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথগ্রহণ করে। রাত ৮টা নাগাদই দরবার হলে অতিথিরা আসতে থাকেন। গত ১৫ বছরে বঙ্গভবনে যারা যাতায়াত করতেন, তাদের অনেকেই এখানে ছিলেন না। এটাই স্বাভাবিক। তাদের কেউ কেউ হয়তো আমন্ত্রণ পেয়েছেন, কিন্তু যাওয়ার সাহস করতে পারেননি। যেমন, মাহি বি চৌধুরী আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পথে ছাত্রদের তোপের মুখে পড়েন তিনি। এটাই স্বাভাবিক। গত ১৫ বছর, বিশেষ করে গত ১০ বছর একটি স্বৈরাচারী মহীরুহকে যারা দিনে দিনে বাড়তে দিয়েছেন বা তৈরি করেছেন, তাদের অন্যতম এ চৌধুরী পরিবার। বদরুদ্দোজা চৌধুরী এক সময় শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, আমি আপনাকে প্রধানমন্ত্রী ও মাহিকে এমপি হিসাবে দেখতে চাই। মাহি ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিকল্পধারা ৩টি আসন লাভ করে। এভাবেই ২০১৮ সালে একটি বিনা ভোটের নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ২০১৪ সালের একদলীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ২০১৮ সালে আরেকটি কারচুপির নির্বাচন করতে সক্ষম হয় শেখ হাসিনা সরকার। সবশেষ ২০২৪ সালে আরও একটি বিনা ভোটের নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়া হয়।
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু গত ১৫ বছর মানুষ যা দেখেছে, তা কি এত সহজেই ভুলে যেতে পারবে? স্বৈরাচার ও এর দোসরদের চেহারাগুলো কি এত সহজেই ভুলে যাওয়া যাবে? বস্তুত কখনো ভুলে যাওয়াই ঠিক নয়। জাতি যদি তার গণতন্ত্রের প্রকৃত শত্রু-মিত্র চিনতে না পারে, তবে তার গণতন্ত্রের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। আমাদের দীর্ঘ ১৫ বছরের স্থবিরতা মূলত গণতন্ত্রের শত্রু-মিত্র চিনতে না পারার কারণে।
বঙ্গবভনের শপথ অনুষ্ঠানে বিএনপির অনেক নেতা ছিলেন। জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের অনেক নেতাও ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনো নেতা ও বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। ২০০৭ সালের পট পরিবর্তনের পরও এমন চিত্রই দেখা গেছে। তখন বঙ্গভবনে বিএনপির কেউ ছিলেন না। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের নেতারা ছিলেন। যদিও এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এবার একটি স্বৈরাচারের পলায়নের পর নতুন আরেকটি সরকার গঠন করা হয়। কাজেই সদ্যবিদায়ি সরকারের বা দলের কেউ এখানে থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।
আসলে আমাদের গণতন্ত্রের উলটো যাত্রার জন্য আমরাই দায়ী। সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষই আজকের গণতন্ত্রহীনতার জন্য দায়ী। মানুষ গত ১৫ বছরে শুধু একটি দলের দিকেই তাকিয়ে ছিল। সবাই গণতন্ত্র চেয়েছে; কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য কেউ রাস্তায় নামেনি। সবাই বিএনপির সমালোচনা করেছে। শেষমেশ একটি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতি স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে পেরেছে।
আগামীর পথটি আমাদের জন্য সহজ নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। তবে মূল কাজ হলো, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর। কারণ, যদি গণতন্ত্র চাই, তাহলে গণতান্ত্রিক দলের কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যতই সংস্কার করুক না কেন, রাজনৈতিক সরকার বা পরবর্তী সরকার যদি তা বজায় না রাখে, তবে এ সংস্কার করে লাভ কী? রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
শেখ হাসিনা সরকার ২০১৪ সালের আগে থেকেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে তারা আগেই সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করে। জনসমর্থন বুঝে সরকার ২০১১ সালে সংবিধানের বেশ কিছু সংশোধন করে। সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধন, ১৯৭২-এর মূলনীতি পুনর্বহাল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তকরণ, নারীদের জন্য সংসদে ৫০টি সংসদীয় আসন সংরক্ষণ ইত্যাদি। এসব সংশোধনীর মূল এজেন্ডাই ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা। এ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করলে প্রথম থেকেই এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল একটি মীমাংসিত বিষয়। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। আওয়ামী লীগই তখন এ দাবি তুলে সারা দেশে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করে। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তারা এ যুগপৎ আন্দোলন করে। বিএনপি অবশেষে এ দাবি মেনে নেয়। সে অনুযায়ী নির্বাচনও হয়। বিএনপি সে নির্বাচনে পরাজিতও হয়। অথচ, ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগই ২০১১ সালে ওই বিধান বাতিল করে ২০১৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, এটা বিশ্বাস হওয়ার কোনো কারণ নেই। সঙ্গত কারণেই বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়, মূলত আওয়ামী লীগের ফাঁদে পড়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ ৬টি আসন বিএনপিকে দিয়ে বাকি সব আসন নিজ দল বা সেবাদাস দলগুলোকে দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি আর যোগ দেয়নি। কিন্তু ততদিনে আওয়ামী লীগ আর নির্বাচন নিয়ে ভাবেও না। নির্বাচন ততদিনে আওয়ামী লীগের কাছে শুধুই এক আনুষ্ঠানিকতা। এভাবে তিন তিনটি নীলনকশার নির্বাচন জাতিকে উপহার দেয় আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্রের উলটো রথে আমরা পিছিয়ে পড়ি বহু পথ।
তবে শেষমেশ মানুষ পথ ছাড়েনি। আশা হারায়নি। দেশের মানুষ যে এসব মেনে নেয়নি, এ অভ্যুত্থানে সেটিই আবার প্রমাণিত হলো। এর আগে মানুষ হয়তো সেভাবে রাস্তায় নামেনি, আর আওয়ামী লীগ সে সুযোগটিই নিয়েছে। জনগণের নীরবতার সুযোগে রাষ্ট্রীয় সব বাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতাকে ধরে রেখেছে।