ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে
গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে ধারণা করেছিলাম, কেউ না কেউ বাণিজ্যের ওপর প্রশ্ন করবেন। বাণিজ্য মানে ঘাটতি বাণিজ্য (ডেফিসিট)। কিন্তু না, এমন কোনো খবর চোখে পড়েনি। অথচ এটি আমাদের কাছে, অনেকের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আবেগের বিষয়ও। অনেকের কাছে রাজনৈতিক ইস্যু। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। যেভাবেই হোক না কেন, বিষয়টি আমাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বহুল চর্চিত বিষয়। সীমান্ত হত্যা সম্পর্কেও জোরালো কোনো প্রশ্ন বা উত্তর দেখলাম না। অথচ এটিও আবেগের বিষয়, ক্ষোভের বিষয়। তবে দেখলাম প্রশ্নে ও উত্তরে আছে যথারীতি তিস্তার পানির বিষয়। তিস্তা চুক্তি ঝুলে আছে অনেকদিন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এর সমাধান চায়, এবার যে ‘ভিজিট’ প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে করেছেন, সেখানেও দেখলাম তিস্তা আছে। কেউ কেউ মনে করতেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার এগোতে পারছে না। আবার বাংলাদেশের অনেক মানুষের ধারণা, কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে প্রাদেশিক সরকার আবার কে? এ বিষয়টি এবার কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। আমাদের কাগজগুলোতে মমতার আপত্তি সম্পর্কিত একটা চিঠির খবর ছাপা হয়েছে। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে তার জোর আপত্তির কথা জানিয়েছেন। তার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশকে পানি দিলে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে খরা দেখা দেবে। সেচ-সুবিধা, এমনকি খাবার জলেরও অসুবিধা হবে। অতএব, কোনো কিছু করার আগে মমতার সঙ্গে কথা বলতে হবে। এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে, যতটুকু যা এগিয়েছে তাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অংশগ্রহণ ছিল।
এসব তর্ক-বিতর্কে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জড়াননি। তিনি তিস্তা সম্পর্কে তার মতামত বিশদভাবে সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেছেন। বলেছেন, চীনের প্রস্তাব আছে, ভারতেরও আছে। দেশের কাছে যেটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা-ই করা হবে। নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কিছুই করা হবে না। এ প্রসঙ্গেই তিনি কিছু বাস্তবতার কথা তুলে ধরেছেন, যা আমাদের কাছে বিবেচনার বিষয়। তিনি বলেছেন, তিস্তার পানির বিষয়টি শুধু ভাগাভাগির বিষয় নয়। মূল সমস্যা তিস্তায় পানির সরবরাহ বাড়াতে হবে। সেখানে সরবরাহ কম। এছাড়া যা বাংলাদেশে কেউ ‘লজ্জায়’ অথবা অন্য কারণে বলতে চান না, তার উল্লেখও তিনি করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, চীনেও পানি তুলে নেওয়া হচ্ছে। এর দ্বারা তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন তা মোটামুটি পরিষ্কার। বোঝা যাচ্ছে, ৫৪টি সীমান্তবর্তী নদীর সমস্যার সঙ্গে তিস্তার সমস্যা যেমন দ্বিপাক্ষিক সমস্যা, তেমনি এটির আন্তর্জাতিক/আঞ্চলিক দিকও আছে। পানির সমস্যা আমাদের ক্ষেত্রে নয় শুধু, ভারতের প্রদেশগুলোর মধ্যেও দক্ষিণাঞ্চলে সমস্যা আছে। আর আমাদের সমস্যার যে আঞ্চলিক দিক আছে, তার সঙ্গে চীন, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ জড়িত। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য দরকার আঞ্চলিক সহযোগিতা। আঞ্চলিক সহযোগিতা শুধু পানির ক্ষেত্রে নয়; বিদ্যুৎ, খনিজসম্পদ, বাণিজ্য, যোগাযোগ সর্বত্রই দরকার আঞ্চলিক সহযোগিতা-বৃহত্তর ‘কানেকটিভিটি’। এর জন্যই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ‘সার্কের’ পাশাপাশি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলছে। দৃশ্যত আমরাও সেই পথেই আছি। রেল, সড়ক, নদীপথ ও সমুদ্রপথে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে।
আমাদের সরকার রেলের ক্ষেত্রে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৯৬৫ সালের পর যে রেলপথগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, ধীরে ধীরে সেসব ‘রুট’ চালু করা হচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রী তার সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন। শত সমালোচনার মুখেও সরকার তার আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করছে, যা প্রশংসনীয়। ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসছে। নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আসবে-এ ব্যাপারে সহমত স্থাপিত হয়েছে। নেপাল-বাংলাদেশ রেল চালু হবে। তা হবে ভারতের মধ্য দিয়ে। পাশাপাশি ভারতও বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে তাদের নিজেদের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করছে। ভারতের পূর্বাঞ্চল আজ শান্ত। এটা বাংলাদেশের অবদান। সেখানে ভারত উন্নয়নের কাজ চালাতে পারছে। এদিকে ৭০-৭৫ বছরের সীমান্ত সমস্যা অর্থাৎ ছিটমহল সমস্যা পারস্পরিক সন্তুষ্টির মধ্যে শেষ হয়েছে। সমুদ্র সীমানা চিহ্নিত হয়েছে। এসব বিষয় আমাদের জানা এবং দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের যে উন্নতি ধীরে ধীরে নতুন নতুন উচ্চতায় উঠছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুদেশের লক্ষ্য হচ্ছে-আমাদের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’ এবং ভারতের ‘বিকশিত ভারত-২০৪৭’। রয়েছে দুদেশের মধ্যে ‘সেপা’ (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট)। দেখা যাচ্ছে, মাত্র দুদিনের সফরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল : সমুদ্র অর্থনীতি, সমুদ্রসম্পদ, রেলওয়ে সংযোগ, ডিজিটাল অংশীদারত্ব, স্বাস্থ্য-ওষুধ-চিকিৎসা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মৎস্য। মোট ১০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি সম্পূর্ণ নতুন এবং তিনটির নবায়ন। এদিকে আলোচনায় এসেছে ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানি চুক্তি, যার মেয়াদ ২০২৬-এ শেষ হচ্ছে। এর নবায়ন এখন সময়ের বিষয়। অবশ্যই এ চুক্তির খুঁটিনাটি উভয়পক্ষ আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এগোবে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ভারত মহাসাগরসহ সমুদ্র ব্যবহারের নীতিমালার বিষয়ে একমত হয়েছে। সমুদ্রের ব্যবহার হবে আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনের মধ্যে।