কোন পথে হাঁটব আমরা
শীত বা প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ কিংবা ঝুম বৃষ্টি—সব ধরনের আবহাওয়াতেই তিনি ফিট বাবু হয়ে থাকেন। ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায়ও লোকটার পরনে থাকে কমপ্লিট স্যুট-প্যান্ট। গরমে কাহিল মানুষ তাঁকে দেখলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে। অতিরিক্ত গরমে কমপ্লিট স্যুট-প্যান্ট পরে নাকি কেউ! এমন বিস্ময় তাঁর চারপাশে। অথচ সেই দিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। রহস্য কী—অনুসন্ধানে থাকেন আশপাশের লোকজন। কেউ কেউ এর কারণ হিসেবে দাঁড় করান তাঁর আর্থসামাজিক অবস্থার উত্থানকে। বলেন, একটা সময়ে লোকটার আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা ভালো ছিল না। অভাব-অনটনে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ। অন্যের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে করতে কায়দা-কৌশলে তিনি এখন সেই প্রতিষ্ঠানের আংশিক মালিক। তাঁর অবস্থার পরিবর্তন যতটা না চেহারায় কিংবা কথায়, তারচেয়ে বেশি তাঁর পোশাকে, ভাবভঙ্গিতে। যখনই প্রতিষ্ঠানের একটা চেয়ার তাঁর হলো, ব্যস, অমনি সাধারণ প্যান্ট-শার্ট শরীর থেকে খসে পড়ে দামি দামি স্যুট-প্যান্ট, সঙ্গে রংচঙে টাই দেহে ঠাঁই পেল। বছরের পর বছর তিনি একই ধরনের পোশাকে নিজেকে মানিয়ে চলেছেন। ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়া অর্থবিত্ত তাঁর এই মানিয়ে চলাকে পাকাপোক্ত করে দিয়েছে এরই মধ্যে।
এই লোক সম্পর্কে একজন বলছিলেন, যখন তাঁর কিছুই ছিল না, কাজের প্রয়োজনে তাঁর কাছে প্রায়ই তিনি আসতেন। টুকটাক কাজ তাঁকে দিয়ে করিয়ে নিতেন। বিনিময়ে পেতেন পারিশ্রমিক। তখন তাঁর সঙ্গে সম্বোধন ছিল ‘তুই’। একদিন অন্যত্র কাজ নিয়ে চলে গেলে সম্বোধন দাঁড়াল ‘তুমি’তে। তারপর বেশ লম্বা সময় পর লোকটি তাঁর কাজের প্রতিষ্ঠানে জায়গা পেয়ে গেলে সম্বোধন দাঁড়িয়ে যায় ‘আপনি’তে। কেমন লাগে এই সম্বোধন পরিবর্তনে—জানতে চাইলে অমায়িক হাসি দিয়ে বললেন, ‘এটাই তো বাস্তবতা। কখন কার কী অবস্থা হয়, কোথায় যায়, কে তা আগর থেকে অনুমান করতে পারে? অবস্থানকে তো আর অসম্মান করা যায় না, সম্মান করতেই হয়।’ তবে পরিবর্তিত লোকটার ভেতর থেকে দিনে দিনে সম্মানবোধটা হারিয়েছে। উন্নাসিকতার ঠাঁই মিলেছে বেশ রকম। তাঁর চলনেবলনে বড়লোকিপনা, আঁতেলগিরির বেশ উপস্থিতি, অতীত নেই একেবারেই। মনে হয়, আসমান থেকে পড়া কোনো মানুষ।
টাকাপয়সা হয়েছে প্রচুর। জীবনযাপনে তার স্পষ্ট ছাপ। আগে রিকশা বা বাসে চড়তেন, এখন কোটি টাকার ব্র্যান্ডের গাড়িতে চলাচল করেন। তাঁর উচ্চতা থেকেও গাড়ির উচ্চতা বেশি। সমাজে বেশ নামডাক ছড়িয়েছে। আজকাল তো টাকা দিয়ে নামডাক কেনা যায়, তৈরি করা যায়। এত টাকা কামিয়েছেন যে, তাঁর কাছে এখন অসাধ্যসাধন বলতে আর কিছুই নেই। সমাজের উঁচুতলায় তাঁর যাতায়াত, কে ঠেকায়! সাধারণত এ ধরনের মানুষের উত্থান কোনো বৈধ ও কাঙ্ক্ষিত নিয়ম মেনে হয় না। যত অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্য দিয়েই তাঁরা এগোন, অথচ মুখে তাঁদের সদা নীতিকথা, মানবতার অভিব্যক্তি। দূরে থাকা জনগণ মনে করে, তিনি আর্তমানবতা ও দেশপ্রেমে নিবেদিত একজন, আদতে যা তিনি নন।
বলতে হয় যে, এমন ব্যক্তির সংখ্যা সমাজে এখন বহুগুণে বেড়ে গেছে। এই বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে একটা কারণ হলো আমাদের দেশে অস্থিতিশীল ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। খেয়াল করলে বোঝা যাবে এর পরিণতি। একটি দেশে যখন রাজাকারের নাম মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় ঠাঁই পায়, আবার একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম চলে যায় রাজাকারের তালিকায়, তখনই অনুমান করা যায় যে, দেশটায় কোন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিচর্চা হচ্ছে। রাজনীতিতে ক্ষমতা, দলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থপরতার প্রকোপ ও আধিক্য এতটাই বেশি যে, ‘দেশপ্রেম ও জনকল্যাণ’ পেছনে পড়ে থাকছে। উন্নয়ন বা অগ্রগতি তো অবশ্যই আছে, কিন্তু সেটা অবকাঠামোয়। ব্যক্তির মনমানসিকতার উন্নতি কতটা হচ্ছে দিনে দিনে, আদর্শ ও নৈতিক মূল্যবোধই বা কীভাবে ব্যক্তির ভেতরে জাগ্রত হচ্ছে, তা নিয়ে বেশ সংশয় রয়ে যায়। সামাজিক যে অবক্ষয়, জীবনযাপনে যে বেপরোয়া মতিগতি, তা কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধহীন সমাজব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলে দেয়। অতিরিক্ত গরমে স্যুট-টাই পরা মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়।
একজন শ্রমিক বলছিলেন, সৎভাবে জীবনযাপন আর সম্ভব হচ্ছে না। ছেলেমেয়ে মানুষ করতে পারছি না। খাবার জোটে না, পড়াশোনা কী করে হয়! ফলে নির্ধারিত কাজের বাইরে তাঁকে অন্য কাজ করতে হয় বাড়তি টাকা কামাইয়ের আশায়। অন্য কাজ অন্য রকম, এত দিনকার মানুষটাকে বদলে দেওয়ার মতো। কী সেটা, জানতে চাইলে বললেন, মাল সরবরাহ করেন ঠিকানা অনুযায়ী। নিজেও জানেন না, কী ধরনের মাল পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। তবে যাদের কাছ থেকে মাল নিচ্ছেন এবং যাদের কাছে মাল পৌঁছে দেন, তাদের দেখে তাঁর সুবিধার মনে হয় না। কখনো জানতে ইচ্ছে হয়নি, কী ধরনের জিনিস তিনি পৌঁছে দিচ্ছেন। ইচ্ছে হলেও আগ্রহ প্রকাশ করেননি। কারণ, তাঁর স্রেফ টাকার প্রয়োজন, জিনিস নয়। তিনি অনুমান করতে পারেন যে, ভালো কোনো কাজ তিনি করছেন না। কিন্তু সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে তিনি কাজটি করছেন। এই শহরে তেমন কোনো আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নেই যে তাঁকে সহায়তা করবে। তবে তিনি এমন না-জানা, অস্বস্তিকর কাজ করতে চান না।
অতি গরমে স্যুট-টাই পরা লোকটার সঙ্গে এই শ্রমিকের জীবনাচরণের মূল পার্থক্য হলো, স্যুট-টাই পরা মানুষটি ধান্দাবাজ, সুবিধাভোগী আর শ্রমিক মানুষটি ধান্দা বা সুবিধায় নন, স্রেফ বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বেঁচে থাকতে চান। সমাজে শ্রমিক মানুষটির মতো অসংখ্য মানুষ রয়েছেন, যাঁরা সৎভাবে জীবনযাপন করতে চান। অথচ তাঁরা পেরে উঠছেন না সংসারের ন্যূনতম প্রয়োজনে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে যদি একজন ব্যক্তি ন্যূনতম আয় করতে সমর্থ না হন, তাহলে তাঁর সামাজিক অবস্থান ও মানসিক অবস্থা কখনোই স্থির থাকবে না। আয়ের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহের ভয়ংকর সংঘর্ষ বেধে যাবে, যাচ্ছেও। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি ভীষণভাবে স্বল্প আয়ের মানুষকে আঘাত করছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখতে তাঁরা যে পথ ও কাজ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, তা কিন্তু সমাজকে সুখকর বার্তা দিচ্ছে না, দেওয়ার কথাও নয়। রাষ্ট্রের জন্য যখন বাৎসরিক পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দ করা হয়, তখন সব বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়।