আওয়ামী লীগের ভয়ের কারণ কী
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১ হাজার ৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে পৌঁছেছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দাবি করছে। আইএমএফের প্রাক্কলন ব্যুরোর চেয়ে কম হলেও তারা বলেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ একটি মাইলফলকে পৌঁছেছে। ২০২০ সালে আইএমএফ দাবি করেছে, করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ভারতীয় অর্থনীতি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হওয়ায় ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ভারতের মাথাপিছু জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে। মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ২০১৫ সালেই ছাড়িয়ে গেছে, ২০২০ সালে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেল। অবশ্য, গত তিন বছর ধরে টাকার অঙ্কে ডলারের দাম বাড়ার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই ২ হাজার ৭৬৫ ডলার থেকে কমে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হওয়ায় ভারতের মাথাপিছু জিএনআই এ বছর আবার বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবু বলব, ২০০৯ সাল থেকে ১৫ বছরে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
এত কিছু সত্ত্বেও ২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ জনগণের মন জয় করতে পারছে না কেন? আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের মনোজগতে হয়তো ১৫ বছর ধরে এমন ধারণা গেড়ে বসে রয়েছে যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এ জন্য ২০১১ সালে তারা সুযোগ পাওয়া মাত্রই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। অথচ দেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ‘অনির্বাচিত’ হওয়ার কারণে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা সত্ত্বেও প্রয়োজনে আরও দুটো নির্বাচন ওই ব্যবস্থার অধীনে করার পক্ষে রায় দিয়েছিল। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি নির্বাচন ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের পথে এগিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা তো এমনিতেই জয়ী হতে যাচ্ছিল, এরপরও কার বুদ্ধিতে আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরাতে হয়েছিল?
গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে আরেকটি একতরফা সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ওই নির্বাচন বয়কট করেছে। এবারের একতরফা নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৪টিতে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬ জন ছাড়া ৫৬ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হওয়ায় ২৮০টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। (জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং কল্যাণ পার্টির বিজয়ী প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত)। নির্বাচনের দিন বেলা ৩টায় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল তখন পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে, যা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। মিডিয়ার কল্যাণে দেখা গেছে, দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে প্রায় সারা দিন ভোটের কেন্দ্রগুলো জনবিরল ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে যে দীর্ঘ ভোটার লাইন দেখা গিয়েছিল, এবার তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। ভোটের পর এখন তারা বলছে, নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের এক ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টিও একেবারেই অবিশ্বাস্য। নির্বাচন কমিশনের দাবি, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে কি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি?
বিরোধী দলগুলোর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি অদূর ভবিষ্যতে পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, অদূর ভবিষ্যতে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনেরও কোনো আশা নেই বলা চলে। এই পর্যায়ে যে প্রশ্নটা সামনে চলে আসে তা হলো, গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রশংসনীয়ভাবে গতিশীল করা সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার ভয় করছে কেন? তারা একতরফা নির্বাচন করার অগ্রহণযোগ্য পথে রয়ে গেছে কেন?