ড. ইউনূসের পক্ষে ড. রেহমান সোবহান : আবেগ বনাম যুক্তি
গত ২১ জানুয়ারি অধ্যাপক রেহমান সোবহানের একটি লেখা দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে। ‘কার জন্য ঘণ্টা বাজছে’ শিরোনামের লেখাটি পড়ে কারো মনে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এটা কি সত্যি কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ, প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী এবং চিন্তার স্বাধীনতার সমর্থক রেহমান সোবহানের লেখা? কর্মজীবনজুড়ে যিনি প্রচলিত অনেক ধ্যানধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং সত্য ও ন্যায়বিচারের অনুসন্ধানে সচেষ্ট থেকেছেন, তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন আত্মস্বার্থ চিন্তায় মগ্ন মানুষের পক্ষে কলম ধরলেন, কোনো সংশয় না রেখে?
আমরা এটা জানি যে, ড. কামাল হোসেন ও হামিদা হোসেনের সহযোগিতায় রেহমান সোবহান ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘ফোরাম’র গোড়াপত্তন করেন। এই প্রকাশনা বাঙালির জাতিগত আকাঙক্ষা, সামরিক ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণার বিরুদ্ধাচরণ এবং সর্বোপরি, পল্লী অঞ্চল ও শ্রমিক সম্প্রদায়ের সদস্যদের নানা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রেহমান সোবহান প্রবাসী সরকারের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এবং বৈশ্বিক সমর্থন ও সহায়তা আদায়ের জন্য নিরলসভাবে কাজ চালিয়ে যান। স্বাধীনতার পর তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন এবং যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় অমূল্য অবদান রাখেন। তিনি আমার মতো বাম-গণতান্ত্রিক চিন্তায় বিশ্বাসী অনেক মানুষের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি।
তিনি যখন ড.ইউনূসের মতো একজন বিতর্কিত আচরণের মানুষের পক্ষে ওকালতি করেন, তখন অবাক না হয়ে পারি না। কোনো মানুষ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ও খ্যাতিমান হয়ে উঠলে কি নিজ দেশের আইন আদালতের ঊর্ধ্বে উঠে যান? নিজের বিত্তবৈভব বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সুনাম কাজে লাগিয়ে অন্য মানুষের ঠকিয়ে, বঞ্চিত করে আইনের আওতামুক্ত থাকার লাইসেন্স পেয়ে যান?
ড. ইউনূস বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী, এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তিনি বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বন্ধু ও সুহৃদ এটাও ঠিক? এমন বিশ্বজুড়ে খ্যাতির অধিকারী আর কোনো মানুষের নাম কি আমরা জানি যিনি লাভজনক ব্যবসায় জড়িয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠকিয়েছেন? ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চলতি বছরের প্রথম দিন ঢাকার একটি শ্রম আদালত ছয় মাসের কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন। এটা নিশ্চয়ই দুঃখজনক। কিন্তু এই বিচার প্রক্রিয়া এড়িয়ে গেলে সেটা কি ওই বক্তব্যকেই সঠিক প্রমাণ করতো না যে ‘আইন হলো মাকড়সার জাল, যা শুধু দুর্বলদের আটকাতে পারে’! আইনের চোখে খ্যাতিমান আর অখ্যাত সবাই সমান- এটা তো রেহমান সোবহানের কাছেই আমরা শুনেছি, শিখেছি। কিন্তু এখন ড. সোবহানের অবস্থান ভিন্ন হলো কেন?
শ্রম আদালতে ড. ইউনূসের মামলা দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হওয়া পছন্দ হয়নি রেহমান সোবহানের। তিনি লিখেছেন, ‘অন্যায্য একটি সমাজে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের অগুনতি ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। এ ধরনের হাজার হাজার মামলা শ্রম আদালতে বিচারের অপেক্ষায় পড়ে আছে। যেখানে মামলার ফাইল চলে শম্বুকগতিতে, রায় হয় কদাচিৎ। আর রায় হলেও কারাদণ্ডের সাজা বিরল। সরকারের অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে খুব কম লোকই এ কথা বিশ্বাস করেন যে অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এমন একটি মামলা করেছেন, যে মামলার বৈশ্বিক প্রভাব থাকতে পারে। আর মামলাটি অভূতপূর্ব গতিতে এগিয়েছে, যাতে রেকর্ড কম সময়ের মধ্যে সাজার রায় হয়ে গেছে।’