সংকট উত্তরণে যথাযথ অর্থনৈতিক নীতি পদ্ধতি বাস্তবায়ন প্রয়োজন
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ৬ নভেম্বর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের নেতাদের সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা করেন। ওই সভায় তিনি যেসব কথা বলেছেন তা কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বক্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। গভর্নর বলেছেন, ‘আমাদের অর্থনীতি বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে। আমার ৩৬ বছরের চাকরি জীবনে আমি কখনই এমন অর্থনৈতিক সংকট প্রত্যক্ষ করিনি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সব সময় জোড়া ঘাটতি নিয়ে আলোচনা করেছি—চলতি হিসাবের ঘাটতি ও রাজস্ব ঘাটতি। গত অর্থবছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি এবং আর্থিক হিসাবের ঘাটতি উভয়ই দেখা গেছে, যা ১৪-১৫ বছরে ঘটেনি। আর্থিক হিসাবে আগের অর্থবছরের ১৫ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত থেকে চলতি অর্থবছরে ২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতিতে পড়েছে। অর্থাৎ ১৭ বিলিয়ন ডলারের একটি ব্যবধান।’ গভর্নর মনে করেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে। আর খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই। এখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। চলতি অর্থবছরই দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে তিনি মনে করেন।
সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি অর্থনীতির আরো নানা চ্যালেঞ্জের বিষয় উল্লেখ করেছেন এবং এসব মোকাবেলায় গৃহীত নানা ব্যবস্থার কথা বলেছেন। যেমন – রেমিট্যান্সের নিম্নগতি, টাকার অবমূল্যায়ন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রফতানি আয় কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, অর্থ পাচার, হুন্ডি ব্যবসা বৃদ্ধি, বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড়ে ধীরগতি ইত্যাদি। অবশ্য এসব চ্যালেঞ্জের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সংবাদপত্রে তার বিস্তারিত উল্লেখ নেই। অর্থ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির মুখ থেকে এ ধরনের স্বীকারোক্তি এর আগে বোধ করি শোনা যায়নি।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কি সত্যিই খুব খারাপ? আত্মসমালোচনা ভালো, যদি এর মাধ্যমে আমাদের সমস্যা ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হই, যদি আমাদের সিদ্ধান্তগুলো পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে জনকল্যাণমুখী হয়।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তন এবং বর্তমান অবস্থায় উপনীত হওয়ার প্রক্রিয়াটি বেশ কয়েক বছর আগেই শুরু হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব এবং তা প্রায় দুবছর স্থায়ী হওয়া, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু এবং তা এখনো চলমান থাকায় সারা বিশ্ব এক অস্থির সময় কাটাচ্ছে। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি, উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে বিপর্যয়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনীতিতে মন্দাভাব প্রভৃতির প্রভাব অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও পড়েছে। তবে আমাদের সমস্যা যে শুধু বৈশ্বিক কারণেই হয়েছে তা নয়। অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, অনিয়ম, দুর্বল করপোরেট শাসন, অনৈতিক ব্যবসা, দুর্নীতি প্রভৃতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে সংকট দেখা দিয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয়, টাকার অবমূল্যায়ন, খেলাপি ঋণ, বিদেশে অর্থ পাচার, আমদানি-রফতানিতে অস্থিরতা, উৎপাদন ও সরবরাহে বিপর্যয় প্রভৃতি যেসব সমস্যা ও সংকট অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে এগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত, সহজ কথায় একটি দ্বারা অন্যটি সৃষ্ট। তবে আমার বিবেচনায় সব সমস্যা ও সংকটের মূলে রয়েছে দুর্নীতি।