শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু। ছবি: সংগৃহীত

নিবন্ধনে বেশি শারীরিক প্রতিবন্ধী, এরপর দৃষ্টি

প্রদীপ দাস
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৩ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:২৪
আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:২৪

(প্রিয়.কম) সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচি চলছে। জরিপ অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি নিবন্ধিত হয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধীরা। এরপর রয়েছে দৃষ্টি, বহুমাত্রিক, বুদ্ধি ও বাক প্রতিবন্ধীর সংখ্যা। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অসুস্থতা, শ্রবণ, অটিজম, ডাউন সিনড্রোম ও অন্যান্য প্রতিবন্ধীর অবস্থান রয়েছে ধারাবাহিকভাবে।

সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচির কাজ শুরু হয়। এই কর্মসূচি চলবে ২০২১ সাল পর্যন্ত।

এই জরিপ দেখে বাংলাদেশে কোন শ্রেণির প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বেশি বা কম, তা নিশ্চিত হওয়ার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, পুরো জরিপ প্রক্রিয়াটাই ত্রুটিপূর্ণ। এই ত্রুটির কথা স্বীকারও করেন জরিপ সংশ্লিষ্টরা।

জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের সাবেক সভাপতি খন্দকার জহুরুল আলম বলেন, ‘শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ তারা কানে শুনছে, কথা বলতে পারছে, দেখছে। ফলে তারা এসে নিবন্ধন করিয়ে গেছে। অন্য প্রতিবন্ধীরা আসতে পারেননি, ওদের মতো।

যারা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, তাদেরকে চিহ্নিত করার মতো ম্যাকানিজম সমাজ কল্যাণ অধিদফতরে নাই। আবার যে চিকিৎসকরা শনাক্তকরণ করেন, তাদের বড় অংশই প্রতিবন্ধিতা বুঝেন না। এসব কারণেই শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে।’

প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কর্মসূচিতে মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে জহুরুল আলমের। তিনি বলেন, ‘তখন আমাদের পর্যবেক্ষণ ছিল। তাতে দেখা গেছে, প্রতিবন্ধিতা সনাক্তকরণ আমাদের সব চিকিৎসকরা বোঝেন না। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক সময় প্রতিবন্ধিতা বলে কিছু ছিল না, এখন কিছু প্রবেশ করানো হয়েছে। যারা মাঠ পর্যায়ে প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণের সঙ্গে জড়িত, তাদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণও নেই। আর এটা থাকারও কথা না। এই ধরনের শনাক্তরণের জন্য বিশেষায়িত লোক দরকার, সেটা নেই।’

প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কর্মসূচির জনবলের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতারও অভাব রয়েছে বলে মনে করেন  জহুরুল আলম। তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধীকে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নিয়ে আসছেন। তাকে তো গাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় নাই। দ্বিতীয় দিন যাবে, সেই খরচ হয়তো সে জোগাড় করতে পারে নাই। তাদের খোঁজ পরবর্তীতে আর নেওয়া হয় না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক মো. সারোয়ার হোসেন খানও মনে করেন, এই শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ । কারণ তিনি নিজে নিবন্ধনের কথা জানতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রচার থেকে। অন্যের কাছ থেকে জেনে নিবন্ধন করেছেন। এখনো অনেক প্রতিবন্ধী রয়েছেন, যারা এই কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত নন।

বাংলাদেশ ভিজ্যুয়ালি ইম্পিয়ার্ড পিপলস সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক নাজমা আরা বেগম পপির অভিযোগ, প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কর্মসূচির কর্মকর্তারা ঠিক মতো নিবন্ধন নেন না।

প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অনেকেই নিবন্ধনের করার ক্ষেত্রে যত্নশীল নয়, এমন বিষয়েও অবহিত আছেন প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কর্মসূচির পরিচালক ডা. আশরাফী আহমদ। তিনি জানান, এই কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে বাজেট প্রয়োজন হয়, তা দেওয়া হচ্ছে না। তিনি এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণও নেননি। দেশের বাইরে যেসব দেশে প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কার্যক্রম চলছে, সেসব দেশে গিয়ে কীভাবে কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে, সেটা দেখার সুযোগও তার হয়নি। আর প্রতিবন্ধীদের নিবন্ধন যে চলমান রয়েছে, এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রচারেরও অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, অটিজম, শারীরিক, মানসিক অসুস্থতাজনিত, দৃষ্টি, বাক, বুদ্ধি, শ্রবণ, শ্রবণ-দৃষ্টি, সেরিব্রাল পালসি, ডাইন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক এবং এর বাইরে অস্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য দেখা দিলে যা স্বাভাবিক জীবন-যাপনে বাধা তৈরি করে এমন ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় (অন্যান্য প্রতিবন্ধী)। এই ১২ ধরনের প্রতিবন্ধী রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষা দিতে এই আইনে তাদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র দেওয়ার বিধানও রাখা হয়েছে।

প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা নিয়ে যা জানাল সমাজসেবা অধিদফতর

সমাজসেবা অধিদফতরের প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, মোট প্রতিবন্ধী ১৫ লাখ ৬২ হাজার ২৫৩ জন। এদের মধ্যে ৯ লাখ ৫০ হাজার ৬৫৭ পুরুষ, ৬ লাখ ৯ হাজার ২০৬ নারী ও ২ হাজার ৩৯০ জন হিজড়া রয়েছে।

জরিপের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে শারীরিক প্রতিবন্ধীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এখন পর্যন্ত ৬ লাখ ৯৩ হাজার ১৬২ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী নিবন্ধিত হয়েছে। এর পর লাখের ওপরে রয়েছে দৃষ্টি, বহুমাত্রিক, বুদ্ধি ও বাক প্রতিবন্ধীরা। তাদের সংখ্যা যথাক্রমে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩১ জন, ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৬ জন, ১ লাখ ২২ হাজার ৫৭৫ জন ও ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৩৪ জন।

কর্মসূচির শুরু থেকে চলতি বছরের ৩ এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ৪৪ হাজার ৮১৮ অটিজম প্রতিবন্ধীদের মধ্যে রয়েছে ২৭ হাজার ৩৬ জন পুরুষ, ১৭ হাজার ৭১৯ নারী, ৬৩ হিজড়া।

৬ লাখ ৯৩ হাজার ১৬২ শারীরিক প্রতিবন্ধীর মধ্যে রয়েছে ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯৯ জন পুরুষ, ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৮৯ নারী ও ১ হাজার ৭৪ জন হিজড়া।

৫২ হাজার ৯৭৫ দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অসুস্থ প্রতিবন্ধীদের মধ্যে ৩০ হাজার ৮৫৬ পুরুষ, ২২ হাজার ৪৪ নারী ও ৭৫ জন হিজড়া।

২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩১ দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর মধ্যে রয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৪৫ পুরুষ, ৯০ হাজার ৭৮৬ নারী ও ১০০ জন হিজড়া।

১ লাখ ১৪ হাজার ৭৩৪ বাক প্রতিবন্ধীর মধ্যে ৬৫ হাজার ২১৪ পুরুষ, ৪৯ হাজার ৪২৪ নারী ও ৯৬ জন হিজড়া।

১ লাখ ২২ হাজার ৫৭৫ বুদ্ধি প্রতিবন্ধীর মধ্যে রয়েছে ৬৯ হাজার ১৬৬ পুরুষ, ৫৩ হাজার ১৭৯ নারী ও ২৩০ জন হিজড়া।

৪৫ হাজার ৭৬৮ শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের মধ্যে রয়েছে ২৫ হাজার ৯০৫ পুরুষ, ১৯ হাজার ৮১৩ নারী ও ৫০ জন হিজড়া।

৬ হাজার ৫২৬ শ্রবণদৃষ্টি প্রতিবন্ধীর মধ্যে ৩ হাজার ৬৪৫ পুরুষ, ২ হাজার ৮৭৯ নারী ও ২ জন হিজড়া। ৭০ হাজার ১৭৪ সেরিব্রালপাল সি প্রতিবন্ধীর মধ্যে রয়েছে ৪২ হাজার ৯১৯ পুরুষ, ২৭ হাজার ২২৮ নারী ও ২৭ জন হিজড়া।

১ লাখ ৮০ হাজার ৪৬ বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে রয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ১৯ পুরুষ, ৭৫ হাজার ৯০৫ নারী ও ১২২ জন হিজড়া।

১ লাখ ৮০ হাজার ৪৬ ডাইন সিনড্রম প্রতিবন্ধীদের মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ৭১৮ পুরুষ, ১ হাজার ৩৫০ নারী ও ৫ জন হিজড়া।

১২ হাজার ৯৭১ অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মধ্যে রয়েছে ৭ হাজার ২৩৫ পুরুষ, ৫ হাজার ১৯০ নারী ও ৫৪৬ জন হিজড়া।

প্রিয় সংবাদ/আজহার