জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নপদ্ধতি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনে জোট বা সমঝোতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন থেকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
জোনায়েদ সাকি: তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলতে একটা নিরপেক্ষ সরকারকে বোঝায়। অন্তর্বর্তী সরকারকে সে রকম নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে হবে। সেদিক থেকে কথাটা যথার্থ, অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করতে হবে।
বিএনপির পরে গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছে জামায়াত। দলটি অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেছে, কিছু কিছু লোক প্রধান উপদেষ্টাকে বিভ্রান্ত করেন, তাঁরা কোনো একটা দলের পক্ষে কাজ করেন। তাঁদের এই মন্তব্যকে কীভাবে দেখছেন?
জোনায়েদ সাকি: উপদেষ্টাদের নিয়ে দলগুলো অভিযোগ করছে, কিন্তু কারও নাম উল্লেখ করছে না। এই নামগুলো সুনির্দিষ্ট হওয়া দরকার। এর মাধ্যমে সরকারের যে নিরপেক্ষতার ভূমিকা, সেটি চারদিক থেকে প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। সরকারকে নিরপেক্ষতার জায়গায় দাঁড়াতে হবে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে অনেকে মনে করেন, সনদ প্রস্তুত, ভিন্নমত, স্বাক্ষরসহ অনেক বিষয়ে বিএনপির চাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আপনার কী মনে হয়?
জোনায়েদ সাকি: বড় দলকে প্রাধান্য দেওয়ার ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়, তবে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি দলেরই অধিকার ছিল। সে কারণেই নোট অব ডিসেন্টকে গুরুত্ব দেওয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত না নেওয়া কিংবা কোনো একটি দল বলেছে বলে সেটা সবাইকে মেনে নিতে হবে, সে রকম কোনো জায়গা যাতে তৈরি না হয়, এর ওপরে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
জুলাই জাতীয় সনদে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করলেও এর বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। এটি রাজনীতিতে কোনো সংকট তৈরি করবে কি না?
জোনায়েদ সাকি: আমরা মনে করি, বাস্তবায়নপদ্ধতি নিয়ে আসলে মোটাদাগে ঐকমত্য হয়ে গেছে। একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের প্রশ্নে প্রায় ঐকমত্য আছে। এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, এটা আদেশ কিংবা অধ্যাদেশের মধ্য দিয়ে হবে কি না? কে আদেশ কিংবা অধ্যাদেশ জারি করবেন, কার মাধ্যমে হবে— এই প্রশ্নগুলো নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্যের জায়গা আছে। আমরা মনে করি, আলাপ–আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছাতে পারব। আমরা যদি সবাই আন্তরিক হই, তাহলে অনৈক্য অনেকটা দূর করা সম্ভব।
জামায়াত নির্বাচনের আগে গণভোট চাচ্ছে...
জোনায়েদ সাকি: নভেম্বরে গণভোট থেকে যে দুটি জিনিস আমরা অর্জন করতে পারব, সেটা একই দিনে হলে কিংবা তার আগে হলে তাৎপর্যগত কোনো পার্থক্য নেই। ফলে অনেকগুলো বিবেচনায় একই দিনে করাটাই শ্রেয়তর।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির একে অপরকে উদ্দেশ করে বক্তব্য, পাল্টা বক্তব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে পারে কি না?
জোনায়েদ সাকি: প্রতিটি দল, দলের প্রার্থীরা যাতে তাঁদের প্রচারণা চালাতে পারেন, রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে পারেন, তবে সেটা যাতে কোনো সংঘাতে পরিণত না হয়, সেদিকটা রাজনৈতিক দলগুলোকে যেমন বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে, সরকারকেও সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা আছে কি না, আপনি কী মনে করেন?
জোনায়েদ সাকি: অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত পুনর্গঠন ও কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা কিংবা এই কাজ যথার্থভাবে সম্পন্ন করতে না পারা মানুষের মধ্যে সংশয় বাড়িয়ে দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো যথেষ্ট কার্যকর হয়নি। ফলে সম্ভাব্য একটা সংঘাতময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তারা কতটা সক্ষম হবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বলেছি, সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে নির্বাচনের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করার একটা কমিটি যেন গঠন করা হয়। তাহলে হয়তো নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে যে আশঙ্কা, সেটা দূর হবে।
বিএনপির পক্ষ থেকে আপনাকে নির্বাচনের মাঠে কাজ করার জন্য ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এটি নিশ্চিত কি না?
জোনায়েদ সাকি: ইতিমধ্যেই গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে আমাদের প্রার্থীর তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া–৬ আসনে নির্বাচনের জন্য আমার প্রার্থিতা ঘোষণা করা হয়েছে। একদিকে গণতন্ত্র মঞ্চের জোটগত প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হচ্ছে, অন্যদিকে যুগপৎ ধারায় যেহেতু বিএনপির সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি, সেখানে নির্বাচনী সমঝোতার প্রশ্নটিও আলোচনার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। সেই আলোচনা সামনে আরও স্পষ্ট হতে পারে।
গণতন্ত্র মঞ্চসহ ৯টি দল জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন থেকে দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক বৃহত্তর সমঝোতার বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক এই সমঝোতার আলোচনা কতটুকু এগোল?
জোনায়েদ সাকি: যখন আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দল গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি ও এনসিপির সঙ্গে আলোচনা করছি, তখন অনেকেই রাজনৈতিকভাবে কোনো নির্বাচনী জোট গঠন করা যায় কি না, সেই আলাপ তুলেছিলেন। আমাদের লক্ষ্য, বড় দলকেন্দ্রিক যে বলয়গুলো হয়েছে, তার বাইরে কোনো একটা নতুন বলয় গড়ে তোলা যায় কি না, সেই চেষ্টা করা। কিন্তু সেটি এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট রূপ পায়নি। আলোচনা চলমান আছে। এই আলোচনা কোনো সুনির্দিষ্ট রূপ পাবে কি না, সেটা নির্ভর করবে আলোচনার প্রক্রিয়ার ওপর।