বেশ কিছুদিন ধরে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। একটি দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন যে প্রধান সংবাদ শিরোনাম হতে পারে, এটি অবাক করার মতো ব্যাপার। ডাকসুর ভোটার সংখ্যা একটি ওয়ার্ডের চেয়েও অনেক কম। তারপরও এটি নজর কেড়েছে।
নির্বাচন হলো মঙ্গলবার। শুনেছি, অনেকেই টেনশনে রাতে ঘুমাতে পারেননি। আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে ফলাফল জানতে পেরেছি। যেহেতু এই নির্বাচন নিয়ে আমার মধ্যে কোনো ‘অবসেশন’ ছিল না, তাই আর দশটা খবরের মতো এটাও স্বাভাবিক মনে হয়েছে।
সকালে আমি হাঁটাহাঁটি করি। তো সেখানে পরিচিতদের সঙ্গে আড্ডা আর চা খাওয়া হয়। আজ সেখানে আড্ডার মূল বিষয় ছিল ডাকসু নির্বাচন। কিছু মানুষ এটাকে সহজভাবেই নিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এ রকমই তো হওয়ার কথা। আবার অনেকেই এটিকে হজম করতে পারছেন না। বলছেন, এটি কী ঘটে গেল!
আমি ১৯৭০ সাল থেকে ডাকসু নির্বাচন দেখে আসছি। আমি দেখেছি, ডাকসুতে কখনোই সরকারের লেজুড় সংগঠন জেতেনি। তার মানে এই নয় যে সরকারি দল নির্বাচন ম্যানিপুলেট করতে চায়নি।
ডাকসুতে সরাসরি ভোটে প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে। সেবার ছিল ছাত্রলীগের জয়জয়কার। ’৭২ সালে ছাত্রলীগ দুই ভাগ হলো। সেই ফাঁকে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন জিতে গেল। ১৯৭৩ সালে চালচিত্র গেল পাল্টে। ছাত্রদের সবচেয়ে লড়াকু আর মেধাবী অংশটি জাসদ-সমর্থিত মুজিববিরোধী ছাত্রলীগের ব্যানারে ডাকসুতে প্যানেল দিল। তাদের ঠেকাতে মুজিববাদী ছাত্রলীগ আর মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন দিল যৌথ প্যানেল।
সন্ধ্যায় ভোট গণনার সময় যখন দেখা গেল জাসদ ছাত্রলীগের জয়রথ এগিয়ে যাচ্ছে, তখন মুজিববাদী যৌথ বাহিনীর সশস্ত্র গুন্ডাদের হস্তক্ষেপে ভোট গণনা ভন্ডুল হয়ে যায়। এ করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। তারা কয়েকটি হলের প্রতিপক্ষ দলের সদস্য বা সমর্থকদের কামরায় হামলা চালায়, লুটপাট করে। ওই রাতে মুহসীন হলের ৩১১ নম্বর কামরার তালা ভেঙে ওরা আমার সবকিছু লুটে নিয়েছিল।
সরকারের চিন্তাটা ছিল এ রকম—একটি ভিন্নমতের সংগঠন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জিতে যাবে, এটি হজম করার মতো মানসিকতা সরকারি দল ও তার সহযোগীদের ছিল না। উপাচার্য ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরীর মধ্যে কোনো মনস্তাপ ছিল না। এরপর তাঁর প্রমোশন হলো। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন। তারপর হলেন মন্ত্রী।
এরপর আমরা দেখলাম, দলীয় সরকারের অধীন জিয়া-এরশাদ জমানায় যতবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে, কোনোবারই সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন জয় পায়নি। একপর্যায়ে গণতন্ত্রের দুই মানসকন্যা গদিনশিন হয়ে ডাকসু নির্বাচনই হতে দেননি।