
দুর্ঘটনায় শুধু শোক নয়, প্রস্তুতি ও দায়িত্বশীলতা চাই
২১ জুলাই দুপুরে একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। আরও অনেকে গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন হাসপাতালে। কাঁদছে পরিবার, স্তব্ধ শহর, ব্যথিত দেশ। কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে—ঘটনাস্থলের বিশৃঙ্খলা, তথ্যের ঘনঘটায় গুজবের বিস্তার, মিডিয়া ও রাজনৈতিক ‘প্রদর্শন’। প্রতিটি উপসর্গই আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্বলতা, নাগরিক চেতনার দুর্দশা ও মিডিয়ার অগভীরতা প্রকাশ করে।
১. তথ্য ব্যবস্থাপনার অভাব: সত্যকে চাপা দেয় ছড়িয়ে পড়া অপসত্য
উন্নত দেশগুলোতে, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান বা নরওয়ে—যে কোনো দুর্যোগে সবার আগে সক্রিয় হয় একটি ক্রাইসিস কমিউনিকেশন টিম। এই টিমে থাকেন সরকারি মুখপাত্র, মিডিয়া বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিগত বিশ্লেষক এবং উদ্ধার কাজে যুক্ত সংস্থার প্রতিনিধিরা। ‘ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম’র (ICS) অধীন দ্রুত সংবাদ সম্মেলন হয়, ৩০-৬০ মিনিটের মধ্যে মিডিয়াকে তথ্য দেওয়া হয়, সামাজিক মাধ্যমে নিশ্চিত তথ্য দিয়ে মিথ্যাচার রোধ করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে? এই বিমানের দুর্ঘটনার পর কোনো লাইভ তথ্য বোর্ড ছিল না, কেউ জানত না মৃত কতজন, কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি কোন ছবি আসল, কোন খবর ভিত্তিহীন। নাগরিকরা ভালোবাসা থেকে তথ্য ছড়াতে গিয়ে গুজবের অনিচ্ছাকৃত বাহক হয়েছেন। অথচ তথ্য ব্যবস্থাপনা এখন জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতির একটি বড় প্রশ্ন।
২. গণমাধ্যম: ভাইরাল নয়, যাচাই-ই সাংবাদিকতার প্রাথমিক শর্ত
সাংবাদিকতা এখন শুধু তথ্য পরিবেশনের পেশা নয়—এটি দায়িত্বের পরীক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক সংবাদমাধ্যমই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে যাচাই না করে তথ্য নিয়ে ছড়িয়ে দেয়। কখনো কোনো শিশুর মিথ্যা মৃত্যু, কখনো কোনো উদ্ধার হওয়া ব্যক্তির ফটোশপড ছবি—এসব দিয়ে সংবাদ তৈরি হয়, যা একদিকে শোকের শোষণ, অন্যদিকে রাষ্ট্রের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
বাইরের অনেক দেশে সাংবাদিকদের জন্য বাধ্যতামূলক দুর্যোগ রিপোর্টিং প্রশিক্ষণ থাকে। যেমন- যুক্তরাজ্যে ‘Disaster Journalism Protocol’ অনুসরণ করা হয়, যেখানে সংবাদকর্মীরা জানেন কখন কোথায় যেতে পারবেন, কাদের সঙ্গে কথা বলা যাবে, কী ছবি নেওয়া যাবে না।
বাংলাদেশেও জাতীয় প্রেস ইনস্টিটিউট বা তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ ধরনের প্রশিক্ষণ থাকা উচিত। এটি শুধু পেশাদারত্ব নয়, শোকের প্রতি ন্যূনতম সম্মান।
৩. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ: হিরোইজম না, সমন্বয় চাই
জাতিসংঘ, রেড ক্রস কিংবা ইউরোপিয়ান সিভিল প্রোটেকশন মেকানিজম—সব সংস্থাই বলে, দুর্ঘটনাস্থলে রাজনৈতিক নেতা বা প্রশাসনের আগমন সমন্বিত হতে হবে। কারণ প্রতিটি অপ্রয়োজনীয় আগমন মানে নিরাপত্তা জটিলতা, মিডিয়ার ফোকাসের বিভ্রান্তি এবং উদ্ধার কাজের বিলম্ব।
কিন্তু আমরা প্রায় প্রতি দুর্ঘটনায় দেখি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা—কোন দল আগে গেলো, কোন নেতা আগে বক্তব্য দিলেন, কে কাকে দোষ দিলেন। দায়িত্ব পালনে আমাদের খ্যাতি না থাকলেও দোষারোপে আমরা বিশ্বপটু। অথচ বিধ্বস্ত বিমানের নিচে চাপা পড়ে থাকা শিশু শিক্ষার্থী বা অন্য মানুষটি হয়তো কোনো দলের নয়— একজন মানুষ, একজন নাগরিক। শোক প্রকাশ দায়িত্বহীনতার প্রতিস্থাপক হতে পারে না।
৪. মানুষের ভূমিকা: ‘ডিজিটাল সহানুভূতি’ একটি নতুন নাগরিকতা
জাপান, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া বা জার্মানির মতো দেশে স্কুল স্তর থেকেই শেখানো হয়—দুর্যোগে নাগরিক আচরণ কেমন হবে। তারা শুধু আগুন বা ভূমিকম্প নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেমন আচরণ করা উচিত, সেটাও শেখে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘Think Before You Share’ কর্মসূচির আওতায় শিশুদেরও শেখানো হয় কোন ছবি শেয়ার করা উচিত নয়, কোন মন্তব্য গুজব হতে পারে।
বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষের দেশে ১০ কোটির বেশি মানুষ মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, কিন্তু তাদের সিংহভাগের এই সংবেদনশীলতার শিক্ষা নেই। ভুয়া উদ্ধারের ভিডিও, মিথ্যা মৃতের তালিকা, বিভ্রান্তিকর ছবি—সবই ছড়ায় একটিমাত্র ক্লিকেই। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘ডিজিটাল সহানুভূতির শিক্ষা’ চালু করা প্রয়োজন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিমান বিধ্বস্ত
- তথ্য প্রকাশ