
শ্রমশক্তি রক্ষায় এখনই কঠোর পদক্ষেপ জরুরি
বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের রেমিট্যান্সনির্ভর অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়, পরিবার চলে, দেশের অর্থনীতির চাকাও ঘোরে। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশ যদি উগ্র মতাদর্শে জড়িয়ে পড়ে, তবে তা শুধু বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বিদেশে শ্রমবাজারেও নেমে আসে অনিশ্চয়তার কালো ছায়া। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় ৩৬ বাংলাদেশিকে আইএসসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তারের ঘটনা তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।
দ্য স্ট্রেইটস টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি সাইফুদ্দিন ইসমাইল প্রকাশ্যে জানিয়েছেন যে এই ৩৬ বাংলাদেশি ‘উগ্র জঙ্গি আন্দোলনের’ সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাঁরা মালয়েশিয়ায় আইএসের মতাদর্শ প্রচার করছিলেন এবং নিজেদের কমিউনিটির মধ্যে সেল তৈরি করে কর্মী নিয়োগের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল উগ্রপন্থী নেটওয়ার্ক তৈরি করে সন্ত্রাসী তহবিল সংগ্রহ, সহিংস কার্যকলাপ সংঘটিত করা এবং এমনকি নিজ দেশের সরকারকে উচ্ছেদ করার মতো চরম পরিকল্পনা।
তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ-সম্পর্কিত অপরাধে মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ১৫ জনকে দেশে ফেরত পাঠানোর আদেশ জারি করা হয়েছে এবং বাকি ১৬ জন এখনো তদন্তাধীন।
উল্লিখিত ঘটনাটি নানা দিক থেকেই অত্যন্ত গুরুতর একটি বিষয়। এর সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্ন জড়িত। আইএস বা ইসলামিক স্টেট আন্তর্জাতিকভাবে একটি নিষিদ্ধ এবং অপরাধমূলক জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ শুধুই ব্যক্তি পর্যায়ের অপরাধ নয়, বরং তা একটি দেশের জাতিগত নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই ‘জিরো টলারেন্স টু টেররিজম’ নীতিতে অটল থাকার কথা বলছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা সেই অবস্থানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
মালয়েশিয়ায় প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত। তাঁরা দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে নিজেদের পরিবার এবং দেশের জন্য রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এই গ্রেপ্তারের ঘটনা বৈধ শ্রমিকদেরও সন্দেহের চোখে দেখার সুযোগ তৈরি করেছে। বিদেশি নিয়োগকর্তারা এমনিতেই কঠোর অভিবাসন নীতি অনুসরণ করছেন, তার ওপর যদি বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে উগ্রবাদী তকমা যুক্ত হয়, তবে শ্রমবাজার হারানো কেবল সময়ের ব্যাপার। এর আগেও মালয়েশিয়ায় কিছু বাংলাদেশি রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যার ফলে তাঁদের কাজের অনুমতি বাতিল করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এবারের অভিযোগ আরও ভয়াবহ। আইএসসংশ্লিষ্টতা আন্তর্জাতিক অপরাধের পর্যায়ে পড়ে এবং এতে শুধু দেশ থেকে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিই তৈরি হয় না বরং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বা পর্যবেক্ষণের আওতায়ও বাংলাদেশ পড়তে পারে। এই পরিস্থিতি ভবিষ্যতে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টিতে বাধা দিতে পারে এবং বিদ্যমান বাজারগুলোকেও সংকুচিত করতে পারে।
আইএসের মতাদর্শ তরুণদের মধ্যে একধরনের গভীর মনস্তাত্ত্বিক মোহ তৈরি করে, যা তাদের যুক্তি ও বিবেচনাশক্তিকে ভেঙে দেয়। এই মতাদর্শ নিজেকে একটি ‘আধ্যাত্মিক দায়িত্ব’ ও ‘জিহাদের মহৎ কর্ম’ হিসেবে উপস্থাপন করে, যা দুর্বলচিত্ত তরুণদের মধ্যে একধরনের আত্মত্যাগী নায়কত্বের ভ্রান্ত ধারণা গেঁথে দেয়। তারা মনে করে, ধর্মের নামে সহিংসতা শুধু বৈধ নয়, বরং তা একটি অনিবার্য কর্তব্য; যা পালন করলেই তারা স্বর্গপ্রাপ্তি বা পরকালীন মুক্তির নিশ্চয়তা পাবে।
উগ্র মতাদর্শের এই আকর্ষণ শুধু একজন প্রবাসী শ্রমিকের জীবন নয়, তাঁর পরিবার, তাঁর প্রবাসী কমিউনিটি এমনকি উৎস দেশ—বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক অবস্থানকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে। কারণ, একজন ব্যক্তি যখন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন, তখন তাঁর মাধ্যমে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হতে পারে। এটি ধীরে ধীরে একটি নেটওয়ার্কে রূপ নেয়, যা থামাতে না পারলে তা পুরো সমাজে সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- উগ্রবাদ
- বৈদেশিক কর্মসংস্থান