আশা-নিরাশা নিয়ে যুগে যুগে জ্ঞানী-গুণী, মহাজনদের মুখনিঃসৃত বাণী আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে বিষম-বিভ্রমের মধ্যে ফেলে রেখেছে। কারণ, তাঁদের কেউ বলেছেন ‘ধন্য আশা কুহকিনি/তোমার মায়ায়, অসার সংসারচক্র ঘোরে নিরবধি, দাঁড়াইত স্থিরভাবে, চলিত না হায়; মন্ত্রবলে তুমি চক্র না ঘুরাতে যদি...’। এখানে আশা হচ্ছে কুহক, মানে ছলনা। যদিও সমগ্র সমাজ-সংসার, রাষ্ট্র-সরকার সবই চালিত হয় আশায় আশায়, তারপরও আশার ছলনায় ভুলে দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ার উদাহরণের অভাব নেই। ২৪ বছরের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম এবং ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বিগত প্রায় সাড়ে পাঁচ দশকের পথচলায় সাধারণ মানুষকে নানাভাবে আশাহত হতে হয়েছে। কাজেই আশাবাদী হওয়ার আগে কি কোনো সাধু সাবধান আছে?
আবার কোনো মহাজনের বাণী হচ্ছে, ‘সংসার সাগরে সুখ-দুঃখ তরঙ্গের খেলা/আশা তার একমাত্র ভেলা।’ অর্থাৎ সুখ-দুঃখ উত্থান-পতন সবই জীবনের অংশ। জীবন চলার পথে এর সবই স্বাভাবিক। কিন্তু হতাশ হলে চলবে না। আশা নামক ভেলায় চড়ে এগিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যতের পথে। আশা করতে হবে যে সেই আগামী দিনগুলো হবে সমুজ্জ্বল। বারবার বহুভাবে আশার ছলনায় দুর্দশাগ্রস্ত, আশাভঙ্গের বেদনায় ভারাক্রান্ত দেশের আপামর সাধারণ মানুষ আমরা তাই আশাবাদীই হতে চাই। এবারের এই আশাবাদ ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর প্রত্যাশায়। ’২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের অন্তরে এই আশাবাদের বীজ বপন করেছে। অভ্যুত্থানের শক্তি এবং অন্তর্বর্তী সরকার নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় আগেই ঘোষণা করেছে। এখন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ পালনের। আগামী ৮ আগস্ট, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের বর্ষপূর্তির দিন এই দিবস পালিত হবে। আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, এটি গতানুগতিক একটি দিবস পালনের মধ্য দিয়েই শেষ হবে না। দিবসটি হবে নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে অগ্রযাত্রার স্মারক।
তবে আশাবাদী আমরা যতই হই না কেন, অন্তর আমাদের পুরোপুরি নিঃশঙ্ক নয় এবং নিশ্চিতও নয়। এর একটা কারণ হতে পারে যে আমরা এ দেশের সাধারণ মানুষ ঘরপোড়া গরু। অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের একেবারেই ভালো নয়। দ্বিতীয় কারণ, অন্তর্বর্তী সরকারের গত প্রায় ১১ মাসের কাজকর্মে নতুন বাংলাদেশের পথে অগ্রগতি বলতে আমরা যা বুঝি, তার খুব কমই দেখতে পাচ্ছি। আমাদের সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো সমাজের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং নিরাপদ জীবনযাপন নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা। এই ক্ষেত্রে বলার মতো কোনো অর্জন হয়নি। সাধারণ মানুষ কোনো পরিসরেই নিরাপদ বোধ করছে না। কার ওপর কখন কোন ট্যাগ লাগিয়ে হামলা-মামলা করা হবে, সেই ভয়ে সবাই ভীত। নারী এবং তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের জীবনে এই ভয় সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্রক্ষমতায় দীর্ঘদিন চেপে বসা একটি স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানো একটি গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর পরও যদি তার ফলাফল হয় আরও বেশি অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা; যদি নবীন রাজনীতিকদের শরীরী ভাষা এবং চোখের চাহনিতে থাকে প্রতিপক্ষকে গিলে খাওয়ার প্রবণতা, তাহলে কীভাবে আমরা নতুন বাংলাদেশের পথে এগোব, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
কিন্তু আমরা কোনোভাবেই চাই না যে জুলাই অভ্যুত্থানের অর্জন ব্যর্থ হোক। ব্যর্থতার গ্লানি বড়ই মর্মান্তিক। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, প্রায় এক যুগ ধরে চলা সামরিক অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান, আরও প্রায় এক যুগ ধরে রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে চলা সেইসব ঘটনার রেশ আমাদের দেশকে, দেশের অগ্রযাত্রাকে দারুণভাবে বিঘ্নিত করেছে। এর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শিকার হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। তারপর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার খোলসে ক্রমান্বয়ে যে স্বৈরশাসনের পত্তন ও বিকাশ হয়েছে, তারও পরিণতি আমরা দেখেছি এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশায় বুক বেঁধেছি। সুতরাং রাজনীতি ও সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে না পারার ব্যর্থতায় জুলাই অভ্যুত্থানের গায়ে ব্যর্থতার ছাপ পড়ুক, সেটা আমরা কোনোভাবেই চাই না। তবে এই ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ১১ মাসের ভূমিকায় আমরা আশান্বিত হতে পারছি না।
রাষ্ট্র ও রাজনীতির মতো উপরিতল মেরামতের যে কাজ অন্তর্বর্তী সরকার করে চলেছে, তার গতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ফল পাওয়ার বিষয়ে সন্দেহ নেই। সরকারের নেওয়া সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রধানতম যে সংবিধান সংস্কারের ধারা, তা এখনো সম্পন্ন
না হলেও, হবে বলে আশা করা যায়। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রধান ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল বিএনপি সাংবিধানিক সংস্কারের অনেক বিষয়েই নমনীয় হচ্ছে। ইতিমধ্যে এক ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার বিষয়ে একমত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর এমনটাই হওয়ার কথা। অবশ্য এখনো সংবিধানের মূলনীতির প্রশ্নে দ্বিমত রয়েছে। এ বিষয়েও শিগগিরই ঐকমত্য হবে বলে আমরা আশা করতে পারি। তবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হবে, বলা কঠিন।
যদিও অনেক দলই সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চায়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের বড় ভয় হচ্ছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে অংশ নেয় বা নিতে পারে, তাহলে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে তারাই হয়তো প্রধান বিরোধী দল হয়ে যাবে বলে অনেকের বিশ্বাস। তাই আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কৌশল কী হতে পারে, সেটা একটা জরুরি বিষয়। তবে কথা হলো, যেভাবে আওয়ামী লীগের বিদায় হয়েছে তারপরও যদি তাদের নিয়ে এতটা ভীত হওয়ার কারণ থাকে, তাহলে তো সেই কারণ উপড়ে ফেলা যাবে না। আওয়ামী লীগের যে ভোট কিংবা সমর্থন, তা কি নাই করে দেওয়া যাবে? দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কী বলে! এর মধ্যে আবার জামায়াতে ইসলামী নতুন করে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তুলেছে। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে দলটির পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। এগুলো কি জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার পাঁয়তারা হতে পারে! আমরা সাধারণ মানুষ অতটা জানি না। বোঝারও কথা নয়।