
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করা কতটা যৌক্তিক
আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজনে আইএমএফের শর্ত মেনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দ্বিখণ্ডিত করে দুটো পৃথক বিভাগ সৃষ্টি করায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর এবং শুল্ক ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের মাঝে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। করনীতি এবং কর ব্যবস্থাপনা দুটোর সমন্বয়েই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গঠিত। দুটোর একক কর্তৃপক্ষ না থাকলে পুরো রাজস্ব ব্যবস্থাপনাই হুমকির মুখে পড়বে। নীতিনির্ধারণ একটি খণ্ডকালীন কাজ, নীতিনির্ধারণী কাজ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে চলার কথা নয়। ধরুন, ৩-৬ মাসের মধ্যে নীতিনির্ধারণী কাজ শেষ হয়ে গেল। তারপর নীতিনির্ধারণী বিভাগ কি বিলুপ্ত করে দেওয়া হবে? নাকি বিনা কাজে অলস বসিয়ে রেখে বেতন-ভাতা প্রদান করা হবে? নীতিনির্ধারণী বিভাগ নীতিমালা নির্ধারণ করে দিল-আর ব্যবস্থাপনা বিভাগ সেটি বাস্তবায়নে মনোযোগ দিল না; সেক্ষেত্রে কি তৃতীয় আরেকটি বিভাগ লাগবে নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাঝে সমন্বয় সাধনের জন্য।
উল্লেখ্য, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ কর্তৃক শুধু কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি-শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়ে থাকে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বসে চেয়ারম্যান ও সচিব, উভয় দায়িত্বই পালন করে থাকেন অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ কর্তৃক করনীতি-কর ব্যবস্থাপনা-শুল্ক নীতি-শুল্ক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনো কর্মই সম্পাদন করা হয় না। এটাই যেক্ষেত্রে বাস্তবতা, সেক্ষেত্রে সরকার কীভাবে ভাবতে পারে করনীতি এবং কর ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক দুটো বিভাগ সৃষ্টি করে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে? নতুন করে সৃষ্ট বিভাগে কর এবং কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়নের সুযোগ থাকার কথা নয়-সে কারণেও করনীতি এবং কর ব্যবস্থাপনার কাজ সেখান থেকে করা সম্ভব হবে না। বিভাগ সৃষ্টি করার আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরিবর্তিত অবস্থান কী হবে, সেটা নির্ধারণ করার আবশ্যকতা রয়েছে-সেটিকে ভেঙে যদি দুটো পৃথক অধিদপ্তর করা হয় তাহলে সেটির সেটআপ কী হবে, সেখানে কর/ শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সদস্য (অতিরিক্ত সচিব) পদমর্যাদার পদ থাকবে কিনা, অধিদপ্তর প্রধান কি সচিব পদমর্যাদার হবে, নাকি অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার হবে, সচিব হলে কি আগের মতো একই ব্যক্তি দুটো পজিশন হোল্ড করবেন-এ বিষয়গুলোর ওপর সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে, অন্যথায় পুরো রাজস্ব ব্যবস্থাপনাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা খাত যেভাবে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে অকার্যকর হয়ে পড়েছে, ঠিক একইভাবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনাও অকার্যকর হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ তো সার্বভৌম গ্যারান্টি দিয়েই আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে, সেখানে নানাবিধ শর্ত আসবে কেন? ঋণ নিয়ে যথাসময়ে সেটি ফেরত দিতে পারবে কিনা, আইএমএফ সেটুকু খতিয়ে দেখতে পারে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার শর্ত মেনে বাংলাদেশ কেন সেই ঋণ নেবে? বাংলাদেশ কি ভীষণ বেকায়দায় পড়েছে যে, আইএমএফের যে কোনো শর্ত মেনে ঋণ নিতে বাধ্য?
রাজস্ব আয় বাড়ানোর পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে লার্জ ট্যাক্স পেয়ারদেরকে প্রদত্ত লক্ষ-কোটি টাকার আয়কর অব্যাহতি। লার্জ ট্যাক্স পেয়ার কারা? লার্জ ট্যাক্স পেয়ার হচ্ছে বড় বড় ব্যবসায়ী এবং এনজিও। দেশে বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার কর ছাড় দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৬৮ শতাংশ বা ৮৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকার করপোরেট কর ছাড় দেওয়া হয়। বাকি প্রায় ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যক্তি পর্যায়ের করদাতাদের। হিসাবটি করা হয়েছে ২০২০-২১ অর্থবছরের আয়কর ধরে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের পরামর্শে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছিল।
নিবন্ধনের বাইরে প্রায় ছয় লাখ বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করছেন। তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনা গেলে বছরে কমপক্ষে দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৮ হাজার কোটি টাকা বাড়তি কর আদায় হবে। এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় এ বিশাল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
আদানির সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি-শুল্ক ও কর অব্যাহতির মাধ্যমে ভারতের আদানি গ্রুপকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকির সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে আদানিকে এ সুযোগ করে দেয়।
সরকারি-বেসরকারি ইকোনমিক জোনে কলকারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেওয়া আছে ১০ বছরের আয়কর অব্যাহতি। ইকোনমিক জোনের বাইরে অবস্থিত পুরোনো কারখানাকে ইকোনমিক জোনের ভেতরে নিয়ে এসে আয়কর অব্যাহতির সুযোগ দেওয়ার অভিযোগও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
এনজিওগুলোর ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সুদের হার কমবেশি ৩০ শতাংশ কিস্তি আদায় কার্যক্রম অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং অমানবিক। দেশি-বিদেশি অর্থ সহায়তায় তারা যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে, সেসব প্রকল্প থেকে তারা অনেক বেশি লাভ করে থাকে। কোনো যুক্তিতেই তারা আয়কর অব্যাহতি পেতে পারে না।
সরকারি কর্মচারী-ছোটখাটো ব্যবসায়ী এবং জনগণের দেওয়া আয়কর দিয়ে কি রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব? রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের আয়কর অব্যাহতি দিয়ে জনগণকে কেন আয়কর প্রদানে বাধ্য করা হবে? সরকারি কর্মচারীসহ জনগণ কেন সেটি নীরবে মেনে নেবে?