
স্থানীয় সরকার কমিশনের সুপারিশ সংবিধান পরিপন্থী
ড. তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন ২০ এপ্রিল সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বর্তমানের প্রত্যক্ষ ভোটব্যবস্থার পরিবর্তে তাঁদের সদস্য ও কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত করার বিধান প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটির এসব সুপারিশ দেখার পর উপমহাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রেরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হবে যে এটি আসলে ১৯৬০-এর দশকের গোড়াতে আইয়ুব খান প্রবর্তিত ‘বেসিক ডেমোক্রেসি’ বা মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থারই হুবহু প্রতিচ্ছবি।
লৌহমানব হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক একনায়ক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর এক ফরমান বলে পাকিস্তানে বেসিক ডেমোক্রেসি (বিডি) বা মৌলিক গণতন্ত্র নামে এমন এক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন, যার আওতায় ‘বিডি মেম্বার’ নামে সমধিক পরিচিত ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যরাই হবেন ক্ষমতার অন্যতম নিয়ামক। এরা ভোট দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে দেশের রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত সবাইকে নির্বাচন করবেন এবং সেটি তাঁরা করতে শুরুও করেছিলেন। ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খান এঁদেরই ‘ব্যয়বহুল’ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তাঁর সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
বিডি মেম্বারদের এরূপ বহুমাত্রিক ক্ষমতার কারণে গোড়া থেকেই তাঁদের নিয়ে বেচাবিক্রির ব্যবসা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছিল। এদের বেশির ভাগই একাধিক দফায় বিক্রি হতেন। ইউনিয়ন পরিষদের কোনো একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়তো গোপনে ১০ হাজার টাকা দিয়ে একজন বিডি মেম্বারকে কিনে নিলেন। কিন্তু অপর চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ততোধিক গোপন সূত্রে সে খবর পেয়ে তাঁকে ৫ হাজার টাকা বেশি দিয়ে ১৫ হাজার টাকায় কিনে নিয়ে ক্রয়কৃত সদস্যকে ভোটের আগের রাত পর্যন্ত এমন কোথাও লুকিয়ে রাখতেন, যাতে প্রথম ক্রেতা তাঁর আর কোনো সন্ধান না পান। ১৯৬৫-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অন্যতম জনপ্রিয় প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য আইয়ুব খানও একই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। ওই নির্বাচনে আইয়ুব খান সারা দেশের ৮০ হাজার বিডি মেম্বারের প্রত্যেককে অর্থ দিয়ে তাঁদের মধ্যকার অধিকাংশকে নিজের পক্ষে টেনে নিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ‘নির্বাচিত প্রেসিডেন্টে’র তকমা গায়ে জড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও পরে ১৯৬৬-এর ছয় দফা-উত্তর আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে এসব কৃত্রিম বৈধতার সবই খড়কুটার মতো ভেসে যায়।
তো ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ভেসে যাওয়া আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রব্যবস্থাকে এত বছর পর আবার কুড়িয়ে এনে পুনঃপ্রবর্তনের আকাঙ্ক্ষা স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্যদের চিন্তায় কেন ও কীভাবে জাগ্রত হলো, তা তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে তাঁদের এ ধরনের পশ্চাৎমুখী, হীনতাপূর্ণ ও অগণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা দলমত-নির্বিশেষে দেশের সব সাধারণ মানুষের মধ্যে শুধু বিস্ময় নয়, প্রচণ্ড ক্ষোভও তৈরি করেছে। দেশের সব কটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ও অন্যান্য ইশতেহারে যেখানে শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে, সেখানে বিদ্যমান প্রত্যক্ষ ভোটব্যবস্থাকে সরিয়ে দিয়ে আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের আদলে স্থানীয় সরকারকাঠামোর সব স্তরে পরোক্ষ ভোটে চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচন এই পুরো ব্যবস্থাটিকেই আরও দুর্বল করে ফেলবে বৈকি! এ প্রক্রিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বা কাউন্সিলররা যদি আবারও ষাটের দশকের বিডি মেম্বারদের মতো রাতে লুকিয়ে থাকার আচরণ করতে শুরু করেন, তাতে মোটেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। তা ছাড়া, এটি তো পুরোপুরিভাবেই গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ক্ষেত্রে স্পষ্টতই এক পশ্চাৎমুখী পদযাত্রা।
কমিশনের প্রতিবেদনে স্থানীয় সরকারকাঠামোর বিভিন্ন স্তরে খণ্ডকালীন সদস্য নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে, যা স্পষ্টতই স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে দলীয় রাজনীতির কদর্যতার মধ্যে ঠেলে দেবে। আইন প্রণয়ন কাজের বাইরে গিয়ে সংসদ সদস্যরা যে এত দিন পর্যন্ত অন্যায়ভাবে স্থানীয় সরকারের কাজে যুক্ত হচ্ছিলেন, যা থেকে তাঁদের বের করে আনা জরুরি বলে সবাই মতামত দিচ্ছেন, এ খণ্ডকালীন সদস্য মনোনয়ন-সুবিধা প্রবর্তন করলে তা নিশ্চিতভাবেই আবারও ফিরে আসবে। আর বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজ ইত্যাদির পরিচালনা পর্ষদে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দূতাবাসের কার্যব্যবস্থার অধীনে অতীতে এভাবে দলীয় ভিত্তিতে প্রতিনিধি মনোনয়ন দেওয়ার কারণেই দেশের বহু প্রতিষ্ঠান অদক্ষতা, বিশৃঙ্খলা ও বিনষ্টির সর্বনিম্ন সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। আর নিজেদের চোখে সরাসরি এসব সর্বনাশ দেখার পরও কি এ রাষ্ট্র পুনরায় সে পথেই হাঁটবে? হীনতায় ভরা এসব সংকীর্ণতাপূর্ণ সুপারিশ দেখে সন্দেহ জাগে, তারা এটি সাময়িক সময়ের জন্য পছন্দের কোনো গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধাদানের জন্য করেনি তো? নইলে যে ধরনের স্বৈরাচারী অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন হলো, আজ এত বছর পর সেটাকেই কেন আবার ফিরিয়ে আনতে চাওয়া? তা ছাড়া, ৫ আগস্টের পরিবর্তন-উত্তর পরিবেশে বিভিন্ন দল, শ্রেণি ও গোষ্ঠীর চাওয়ার মধ্যে পারস্পরিক নানা পার্থক্য থাকলেও কেউই নিশ্চয় আইয়ুবের অগণতান্ত্রিক মৌলিক গণতন্ত্রব্যবস্থায় ফিরে যেতে চান না, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্যরা ছাড়া।
কমিশন কর্তৃক স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় সরকারি কর্মচারীদেরও অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশে একটি শক্তিশালী ও স্বনির্ভর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত ৫৪ বছরের বিভিন্ন সময়ে ও পর্যায়ে বিভিন্ন মহল থেকে বহু প্রস্তাব ও সুপারিশ এসেছে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই সেসব সুপারিশ ও প্রস্তাবের মধ্যে নানামাত্রিক ভিন্নতাও রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি বিষয়ে সবাই একমত যে স্থানীয় সরকারকে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত রাখা প্রয়োজন, যাতে রাজস্ব আহরণ, বাজেট প্রণয়ন এবং বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজটি তারা যেন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে করতে পারে। কিন্তু এই প্রথমবার এ ব্যাপারে একটি বিপরীতধর্মী প্রস্তাব এল, যেখানে স্থানীয় সরকারকে সরকারি কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত না রেখে বরং অধিক সংখ্যায় যুক্ত রাখার প্রস্তাব করা হলো। বিষয়টি শুধু দুর্ভাগ্যজনকই নয়—সরকারের সংস্কার-চিন্তাসংক্রান্ত ধারণা ও বক্তব্যের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী তারা সংস্কার চাইছে ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তো মৌলিক গণতন্ত্রকে ডেকে এনে প্রকারান্তরে ফ্যাসিবাদকেই প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। আর প্রায় ছয় দশক আগে জনগণ যেটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, ছয় দশক পরে এসে এ স্বাধীন দেশে সেটিকে নতুন বন্দোবস্ত বলার তো কোনোই সুযোগ নেই। তাহলে কমিশন যে সুপারিশগুলো রাখল, তার প্রকারান্তরিক উদ্দেশ্য কী? পাকিস্তানি যেকোনো ব্যবস্থাকে আপন ভাবার ভাবাদর্শিক রাজনীতি না তো?