
এখনই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়
গত সপ্তাহে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আশাজাগানিয়া একটি খবর প্রচারিত হওয়ার পর দেশব্যাপী বেশ আলোচনা চলছে। ৫ এপ্রিল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ইউ থান শিউ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমানকে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার যোগ্য বলে জানিয়েছেন। মূলত এ তথ্যটি প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে পোস্ট দেওয়ার পর চারদিকে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে আরও জানা যায়, বাংলাদেশের দেওয়া তালিকায় থাকা ৮ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে মিয়ানমার ১ লাখ ৮০ হাজার প্রত্যাবাসনের জন্য যোগ্য বিবেচিত হলেও চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে ৭০ হাজার রোহিঙ্গার নাম ও ছবি আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর বাইরে আরও সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাইয়ের কাজ জরুরি ভিত্তিতে করবে বলে জান্তা সরকার জানিয়েছে।
২০১৮-২০ সালে বাংলাদেশ মোট ছয় ধাপে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের তালিকা দেয়। ওই তালিকা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে ১ হাজার ১০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্পও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি সফল হয়নি। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল মিয়ানমার। চুক্তি স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর কথাও ছিল। এ চুক্তি নিয়ে তখন ব্যাপক সমালোচনাও হয়েছিল। কারণ, তখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান ও নিজ বাস্তুভিটায় ফেরার ব্যাপারে মিয়ানমার জান্তার পক্ষে কোনো পজিটিভ সাড়া না পাওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তখন আট দফা দাবি পেশ করেছিল। সেসব বিষয়েও কোনো মীমাংসা হয়নি সে সময়ে। সুতরাং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এত দিন নিশ্চুপ থাকার পর হঠাৎ এভাবে মিয়ানমার সরকারের ঘুম ভাঙার খবরে সবাই যেন নড়চড়ে বসেছে। তাদের সবারই অভিমত, রাখাইনে আরাকান আর্মির কাছে জান্তা বাহিনী উপর্যুপরি মার খাওয়ার পর ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরতযোগ্য ঘোষণা, মিয়ানমার সরকারের কোনো অপকৌশল কি না ভেবে দেখতে হবে।
মিয়ানমারের এই ঘোষণা কূটনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখছেন দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। রাখাইন অঞ্চল এখন আর মিয়ানমার জান্তার নিয়ন্ত্রণে নেই। ওই অঞ্চলের অধিকাংশ ভূখণ্ড এখন আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ করছে। এমতাবস্থায় জান্তা গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের কোথায় পুনর্বাসন করবে, তা নিয়ে আছে ধোঁয়াশা। কারও কারও অভিমত যে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার এখন তাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি রক্ষায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনা করছে। তারা কিন্তু আগের কোনো প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেনি। এসব হলো তাদের রাজনৈতিক অর্থহীন কথাবার্তা, যার কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। মনে রাখতে হবে, জান্তা সরকার রাজি হলেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আদৌ সম্ভব কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। আরাকান আর্মিকে পাশ কাটিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। রাখাইনের যেসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের বসতি, সেগুলো এখন আরাকান আর্মির দখলে। রাখাইনের জনসংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। সেখানকার মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ বৌদ্ধ এবং ৩৫ শতাংশ মুসলিম রোহিঙ্গা। জনসংখ্যার বিচারে রোহিঙ্গাদের অবস্থান নেহাত কম নয়। তারপরও কথা থেকে যায়। কয়েক বছর যাবৎ আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মিয়ানমার জান্তা কৌশলে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেছে। ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর আরাকান আর্মির ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।