
মূল্যস্ফীতি, খাদ্য এবং পুষ্টি
মূল্যস্ফীতির লাগামহীন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা প্রায় তিন বছর ধরে চলছে। বর্তমান সরকারের আমলে ছয় মাসের মতো। পিষ্ট সাধারণ মানুষ এই মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে। হ্যাঁ, খুব প্রান্তিক, বোধ হয় এক শতাংশ, মূল্যস্ফীতির উত্তাপ কমেছে মূলত সংকোচনমূলক নীতির কারণে। আরও কমতে পারত যদি চাঁদাবাজি বন্ধ করা যেত, যা নীতিনির্ধারকদের মুখেই শোনা, কিন্তু আসলে কমেনি; এক দল বিদায় নিয়ে অন্য এক দল দখলে নিয়েছে হাট-ঘাট, বাজার, বাসস্ট্যান্ড। স্বয়ং টিআইবি মনে করছে যে, এমনকি জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে জড়িতদের কিছু অংশ এসব মচ্ছপে যোগ দিয়েছে। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক আপদ তাড়ানোর পর বিপদ এসে হাজির।
দুই. একজন মানুষের সুস্থভাবে জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্যশক্তি গ্রহণ করতে হয়, তার পরিমাণ ২,১০০ কিলোক্যালরি। এটা কিন্তু গড়পড়তা হিসাব পেশা কিংবা অঞ্চলভেদে ওপর-নিচ হতে পারে। বিভিন্ন খাদ্য থেকে এই ক্যালরি আসে। যেমন চাল, ডাল, তেল, শাকসবজি, ফলমূল, ডিম, দুধ, মাংস ইত্যাদি। বাজার থেকে যদি ২১০০ ক্যালরি সমেত খাবার কিনতে হয় তাতে প্রতি মাসে, বর্তমান বাজার দরে, ব্যয় হওয়ার কথা প্রায় দুই হাজার টাকা। সরকারিভাবে এটিকেই ‘ফুড পোভার্টি লাইন’ বা ‘খাদ্য দারিদ্র্যসীমা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বণিক বার্তা পত্রিকার বরাত দিয়ে বলা যায়, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সাম্প্রতিক এক হিসাব অনুযায়ী, জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যশক্তিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে এখন প্রতি মাসে মাথাপিছু ব্যয় করতে হচ্ছে ৩০৫১ টাকা। সে অনুযায়ী, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ইদানীং ন্যূনতম খাবার গ্রহণে একজন মানুষের ব্যয় হচ্ছে খাদ্য দারিদ্র্যসীমার চেয়ে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। নির্ভরযোগ্য উপাত্ত জানাচ্ছে, গেল ২-৩ বছর এবং টানা ছয় মাস ধরে ১০ শতাংশের ওপরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কখনো-সখনো ১২ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশে প্রচুর মানুষ আছে, যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে বসবাস করলেও কচুরি পাতার ওপর পানি যেমন তারাও ঠিক তেমনি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছেন। অর্থনৈতিক সামান্য ধাক্কা বা অভিঘাতেই তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসার জোর আশঙ্কা রয়েছে। বলা বাহুল্য, এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত অভিঘাত নেই, পুরোটাই মানুষের সৃষ্টি। যেমন রাস্তা অবরোধ কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে দরিদ্রের আয়-রোজগার হ্রাস পাওয়া। অর্থনীতিবিদদের আনুমানিক হিসাবে এমন দরিদ্রের সংখ্যা না হলেও, অন্তত দুই কোটি এবং বলা বাহুল্য যে বর্তমান পরিস্থিতিতেও এরাই সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছেন। অত্যন্ত দরিদ্র যারা তাদের অনেকে চিকিৎসা ও পড়াশোনার ব্যয় কমিয়ে, তা দিয়ে পুষ্টি ব্যয় নির্বাহের চেষ্টাও করছেন। এ পরিস্থিতিতে এখন রোগ-বালাই ও অশিক্ষা বেড়ে গিয়ে সামগ্রিকভাবে সমাজের অর্থনৈতিক উৎপাদন সক্ষমতাও কমে আসার জোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মূল্যস্ফীতি
- মূল্যস্ফীতির হার