সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ গেলে কী হবে?
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সংবিধান সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে বেশ কিছু ‘বৈপ্লবিক’ সুপারিশ রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তন। কমিশনের প্রস্তাব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম হবে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে এসে দেশের সাংবিধানিক নাম কেন পরিবর্তন করতে হবে, দেশের মানুষ আদৌ এই পরিবর্তন চায় কি না, এই বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে উঠবে কি না, সেটি ভিন্ন তর্কের বিষয় হলেও সুপারিশটাকে বৈপ্লবিক বলে মানতে হবে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নতুন রাষ্ট্রের জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, সেই সংবিধানের প্রস্তাবনাও নতুন করে লেখার সুপারিশ করেছে কমিশন। তারা একটি প্রস্তাবিত প্রস্তাবনাও এর সঙ্গে যুক্ত করেছে— যেখানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মতো গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকেও।
সংবিধানের বিদ্যমান চারটি মূলনীতির (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা) মধ্যে তিনটি বাদ দিয়ে শুধু ‘গণতন্ত্র’ রেখে একটি নতুন মূলনীতি তারা যুক্ত করার সুপারিশ করেছেন, সেটি হলো ‘বহুত্ববাদ’। এই দুটির সঙ্গে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সময় জারিকৃত প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স বা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত তিনটি অধিকার ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ যুক্ত করারও সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থাৎ কমিশনের প্রস্তাব মতে সংবিধানের মূলনীতি হবে পাঁচটি। এগুলো হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র। যদিও বলা হয় যে, গণতন্ত্রের মধ্যে বাকি সবগুলোই নিহিত আছে। অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্র যদি শুধু তার নাগরিকের জন্য প্রকৃত গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে পারে তাহলে সেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সুবিচার ও বহুত্ববাদ— সবই চলে আসে।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম
ইরেজি সেক্যুলারিজমের বাংলা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ হয় কি না সেটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও শব্দটি সাধারণ মানুষের বোধগম্য। অনেকে সেক্যুলারিজমের বাংলা ‘ইহজাগতিকতা’ লিখতে ও বলতে পছন্দ করেন এবং এটিই অধিকতর শুদ্ধ বলে মনে করেন। কিন্তু শব্দের এই মারপ্যাঁচে না গিয়েও এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, আধুনিক রাষ্ট্র মানেই ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মীয় রাষ্ট্র বা কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে বাকি সব ধর্মের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
১৯৭২ সালে যখন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তখন সংবিধানটি পুরোপুরি ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত ছিল। এমনকি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এ কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সর্বশক্তিমান পরম করুণময় দয়াময়ের নামে’ যুক্ত করার প্রস্তাব দিলেও সেটি গৃহীত হয়নি।
তবে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে রাষ্ট্রপতির দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশ নম্বর ৪-এর দ্বিতীয় তফসিলবলে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে) যুক্ত করা হয়—যাকে পরের বছর ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল গৃহীত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়। এর ৩২ বছর পরে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করা হলেও প্রস্তাবনা থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ বাদ দেওয়া হয়নি। তবে এর অনুবাদে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। এখন সংবিধানের শুরুটা এরকম: ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে) পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’।
বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ২ নম্বর অনুচ্ছেদের বিষয় ছিল প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানা। কিন্তু ১৯৮৮ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী এনে ‘২ক’ নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করে রাষ্ট্রধর্মের বিধান করেন। সেখানে বলা হয়: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের মূলনীতিসহ অনেক বিধান ফিরিয়ে আনা হলেও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখা হয়। তবে বাক্যটি সর্বজনীন করার চেষ্টা করা হয়। যেমন সংবিধানে এখন রাষ্ট্রধর্মের অনুচ্ছেদটি এরকম: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা না হলেও এই অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে ইসলামের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মকে সমমর্যাদা দেওয়া হয়। যদিও কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে অন্য ধর্মের সমান মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি একধরনের গোঁজামিল হয়ে যায়।