কর ফাঁকি না ধরে ভ্যাট বাড়ানোর সহজ রাস্তা কেন?
দেশে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ নেই; কিন্তু এর মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার আইএমএফের শর্ত মেনে ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন, ব্যবসায়ীসহ অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অধ্যাদেশ জারির জন্য উপদেষ্টা পরিষদ সম্প্রতি মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুমোদন দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই অধ্যাদেশ অনুমোদনের বিষয়টি জানানো হলেও ভ্যাটের বিষয়ে কী কী পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। (হঠাৎ কর বাড়ানোর উদ্যোগ, খরচ বাড়বে মানুষের, প্রথম আলো, ২ জানুয়ারি ২০২৫)
এ বিষয়ে এনবিআরের সূত্র ধরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যাচ্ছে, এই অধ্যাদেশ জারি হলে ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়বে। এর মধ্যে মুঠোফোনের সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ, সরবরাহ পর্যায়ে ওষুধের ভ্যাট ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ, এলপিজি গ্যাসের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হবে। যেসব রেস্তোরাঁয় বর্তমানে ৫ শতাংশ এবং হোটেলে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। তৈরি পোশাকের ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে।
এভাবে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর ফলে আরও দাম বাড়বে গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো সস, এইচআর কয়েল, সিআর কয়েল, চশমার ফ্রেম, সানগ্লাস, টয়লেট টিস্যু, মিষ্টি, গাড়ির ওয়ার্কশপ, তাজা-শুকনা সুপারি, ফলের রস, তাজা ফল, সাবান-ডিটারজেন্ট, রং, সিগারেট, বিমানের টিকিট ইত্যাদির। (উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেবে নতুন ভ্যাট, সমকাল, ৩ জানুয়ারি ২০২৫)
শুধু তা–ই নয়, বিদ্যমান নিয়মে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের টার্নওভার বা বার্ষিক বিক্রি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে তার জন্য ৪ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য ছিল। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে কোনো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রি ৫০ লাখ টাকা, অর্থাৎ দৈনিক বিক্রি গড়ে ১৩ হাজার ৬৯৮ টাকা পার হলেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় চলে আসবে। এর ফলে বিপুলসংখ্যক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট বেড়ে যাবে, যা মূল্যস্ফীতির ওপর আরও বেশি চাপ তৈরি করবে। (ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রি ৫০ লাখ টাকার বেশি হলে দিতে হবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অনলাইন, ১ জানুয়ারি ২০২৫)
মূল্যস্ফীতি নিয়ে পুরোনো যুক্তি
সরকার ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিল এমন একসময়ে, যখন টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে কষ্টে আছে সীমিত আয়ের মানুষ। ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে দেশের ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দাবি করেছেন, ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। ২ জানুয়ারি তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা সেই ছাড়টা দেখবেন।’ উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশেই, এমনকি নেপাল, ভুটানেও বাংলাদেশের মতো এত কম কর (ট্যাক্স) নেই। (কর বাড়লেও জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়বে না: অর্থ উপদেষ্টা, প্রথম আলো অনলাইন, ২ জানুয়ারি ২০২৫)
অর্থ উপদেষ্টার এ ধরনের বক্তব্য বিগত সরকারের মন্ত্রীদের দায়িত্বহীন কথাবার্তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আজ থেকে তিন বছর আগে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘মূল্যস্ফীতি সারা বিশ্বেই আছে। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নেই। গত ১৫ বছর মূল্যস্ফীতির হার গড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে আরও বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল। কাজেই আমি বলব, বাংলাদেশ একটি অসাধারণ দেশ। আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতি নেই।’ (দেশে মূল্যস্ফীতি নেই : অর্থমন্ত্রী, দেশ রূপান্তর, ২ জানুয়ারি ২০২২)
অর্থ উপদেষ্টা অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের শুল্ক কামানোর কথা বলেছেন; কিন্তু বাস্তবতা হলো, চাল, আলু, চিনি, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ইত্যাদি নিত্যপণ্যের শুল্ক হ্রাস করা হলেও মূল্যস্ফীতি কমেনি। শুল্ক ছাড়ের সুবিধা কতটা সাধারণ মানুষ পেয়েছে, আর কতটা ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকেছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। (২০০০ কোটি টাকা ছাড়ের সুফল পাচ্ছে না জনগণ, যুগান্তর, ১৮ নভেম্বর ২০২৪)
সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, অক্টোবরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৮৭, যা নভেম্বরে বেড়ে হয় ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বাংলাদেশের এই মূল্যস্ফীতির হার গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। (মূল্যস্ফীতি না কমলেও অনেক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা অস্বাভাবিক বেড়েছে, বণিক বার্তা, ২ জানুয়ারি ২০২৫)
- ট্যাগ:
- মতামত
- ভ্যাট
- মূল্যস্ফীতি
- কর বৃদ্ধি