
মন্দ ঋণের শিক্ষা: নিরীক্ষকের ডায়েরি থেকে
আমার অডিট বা নিরীক্ষক–জীবনের হাতেখড়ি ১৯৯০ সালে। এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে আমাদের ট্রেজারি অডিট করতে এসেছিলেন প্রভাত গুপ্তা। তিনি আমাকে মুম্বাই ট্রেজারি রিভিউ টিমের সদস্য করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে আমাকে হংকংয়ে ‘লার্জ চায়না করপোরেট’ অডিট টিমের সদস্য বানানো হয়। পরে এশিয়ার বেশ কটি দেশে, ইউরোপের দু-তিনটি দেশে এবং পূর্ব আফ্রিকার কয়েকটি দেশে অডিট, ডিউডিলিজেন্স ও পোর্টফোলিও রিভিউতে জড়িত হয়েছি। তা ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া, গণচীন ও তুরস্কে আমার নিয়োগকারী ব্যাংকের পক্ষে স্থানীয় কিছু ব্যাংকের অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম।
ইন্দোনেশিয়ায় ঋণ কর্মকর্তার বৈদেশিক মুদ্রা রূপান্তর বা মুদ্রা বিনিময় হার ওঠানামার ঝুঁকি বুঝতে না পারার ব্যর্থতায় অনেক ঋণকে মন্দ হতে দেখেছি। মেয়াদি প্রকল্পের অর্থায়নের কাজে স্বল্পমেয়াদি চলতি ঋণের ব্যবহার মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে মন্দ হতে দেখেছি—এ পরিস্থিতি অনেকটাই বাংলাদেশের মতো।
তাইওয়ানে অনেক মিডল মার্কেট লোন মন্দ হয়ে গিয়েছিল; কারণ ছিল ট্রেড সাইকেলের তুলনায় ঋণ পরিশোধে সময় কম দেওয়া। ভারতে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে জামানতে ঘাটতি নিয়েও ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে। পূর্ব আফ্রিকার বেশির ভাগ ঋণ মন্দ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যবসায়ের ঝুঁকি নিরূপণের দক্ষতার অভাব। এ জন্য ঋণগ্রহীতারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ তুলে নিয়ে যান। তুরস্কে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঋণের টাকা আর ব্যাংকে ফেরত আসেনি।
আমরা বাংলাদেশেও দেখেছি কীভাবে শিল্প ঋণ নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। পাকিস্তানে ‘নেম লেন্ডিং’ বা ‘ইনফ্লুয়েন্সড লেন্ডিং’ অনেক ব্যাংককে দেউলিয়া হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছে। অনেক সময় চাপ এসেছে, এমনকি সরকারপ্রধান থেকেও। এ ক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকার ঘটনাগুলো আবার বৈদেশিক মুদ্রার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা–সংশ্লিষ্ট, যখন ইউরোপ এমনকি উত্তর আমেরিকার ঘটনাগুলো সংশ্লিষ্ট অন্তর্নিহিত সম্পত্তি মূল্যের চরম পতনের সঙ্গে, যা সেখান থেকে বের হয়ে আসাকে প্রায় অসম্ভব করে দেয়।
বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা থাকতে হবে, নদী দূষণ করা যাবে না—কর্তৃপক্ষের এ ধরনের বাধ্যবাধকতা না মানার কারণেও ঋণ মন্দে পরিণত হতে দেখা যায়। এসব নিয়ম না মানলে সামাজিক গোষ্ঠীগুলো এসব কারখানা বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করে বা করতে পারে। তার অনেক উদাহরণ আমরা দেখতে পেয়েছি ভারতে। ভারতে মানেকা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিবেশ আন্দোলন গোষ্ঠী প্রয়োজনীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় কাবেরী নদীর মৎস্যসম্পদ বিনষ্ট করছে—এ অভিযোগে একটি বৃহৎ টেক্সটাইল মিল বন্ধ করতে বাধ্য করে।
ভুল ভূমি অধিগ্রহণ, যেমন স্কুল বা প্রার্থনার জায়গা নিয়ে কারখানা স্থাপন করতে গেলে বাধা আসতে পারে। এর ফলে কোম্পানিকে কারখানা অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে হতে পারে, যার ফলে অবধারিতভাবে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়।
এ ছাড়া মূল ব্যক্তির মৃত্যু হলে এবং তাঁর কোনো যোগ্য উত্তরসূরি না থাকলে কিংবা উত্তরসূরিদের মধ্যে মতভিন্নতা থাকলে অনেক ঋণই ঝুঁকিতে পড়ে। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া এমনকি ভারতেও আমরা এগুলো হতে দেখেছি। এমনকি বাংলাদেশেও স্কুলের জমি জামানত রেখে একই মালিকের পোলট্রি খামারে দেওয়া ঋণ অনাদায়ি হলে ব্যাংক স্কুলের জমি বিক্রি করতে গেলে আদালতের নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়।