ক্ষমতা, বিচার ও রাজনীতি–নতুন পথে কি হাঁটবে বাংলাদেশ?
শেখ হাসিনার বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে কি হবে না, তাকে ভারত বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে কি, দেবে না, এই রায়ের পরে তার দল কিভাবে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে–সেটা এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। কিন্তু সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে বাংলাদেশের রাজনীতি, রাষ্ট্রক্ষমতা ও সরকার নিয়েই কিছু প্রশ্ন জাগছে।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের এই পরিণতি কি অপরিহার্য ছিল?
গত দুই দশকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ যে পথে হেঁটেছে তাতে এই পরিণতির বাইরে অন্য কিছু কি ঘটা সম্ভব ছিল?
আর এই পরিস্থিতিতে সংবাদকর্মী হিসাবে, দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে আমাদের কর্তব্যই বা কি ছিল? আমরাই কি করেছিলাম বা করতে পেরেছিলাম?
এই ভাবনাটা এমনভাবে পেয়ে বসল যে, রায় ঘোষিত হওয়ার পরে পুরনো দিনের পত্রিকা ঘাঁটতে বসলাম। হাতের কাছে খুব বেশি কিছু না পেলেও ২০১৫-২০১৬ সালের কিছু পত্রিকা পেলাম। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। শেখ হাসিনা তখন আকাশছোঁয়া ক্ষমতার অধিকারী। ফকিরকে রাজা আর রাজাকে ফকির বানানোর ক্ষমতা তার হাতে। দেশের বিরোধী দল, দলের শীর্ষ নেতাকে জানে বাঁচিয়ে রাখলেও প্রায় অকেজো করে ফেলেছেন। রাজনীতিতে–সমাজে তখন অস্থিরতা তীব্র-কিন্তু সবকিছুকেই কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন হাসিনা। দল, সরকার, রাষ্ট্র-পুরোটাই সেসময় একমাত্র ‘হাসিনা-বিন্দুতে’ই বিরাজমান। আমাদেরও কলম তখন চালাতে হচ্ছে নানারকম ইঙ্গিত ও আকার দিয়ে। সে সময় নিউজ ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক’ পত্রিকায় লিখেছিলাম, “বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখন নিরীক্ষাময় অস্থিরতার কালপর্ব অতিক্রম করছে। এখানে গণতান্ত্রিক বিকাশের বদলে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে উন্নয়নের মোড়ক দিয়ে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জনগণের ক্ষোভ, মতামত কিংবা ভাব প্রকাশকে সংকুচিত করে ‘উন্নয়ন’কে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। বলার চেষ্টা হচ্ছে গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন জরুরি। বাংলাদেশের আগে পৃথিবীর বহু দেশে এই মডেল কার্যকর করতে গিয়ে, দীর্ঘমেয়াদে সুফল আসেনি। বরং পৃথিবীব্যাপী অস্থিরতা এই মডেলের পরীক্ষাকে আরও বিপদসংকুল করেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে এই নীরিক্ষা বিপজ্জনকভাবে চরমপন্থাকে উৎসাহিত করেছে। ফলে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক না হয়ে অধিকতর সামরিকীকরণের পথে হেঁটেছে। সেই সামরিকীকরণ সমাজকে বিকাশের বদলে আরও পেছনে ঠেলেছে। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি তাই এই বিপদপীড়িত নিরীক্ষা থেকে না বেরুলে অস্থিরতার ক্ষয়িষ্ণুরোগ তাকে আরও রোগগ্রস্থ করতে পারে। উন্নয়নের সব বিকাশ শেষে অস্থিরতার ক্যানসার হয়ে সব অর্জন ধ্বংস করতে পারে। সুতরাং আমাদের প্রকৃত গণতান্ত্রিক বিকাশকে যেকোনো মূল্যে বিকশিত হওয়ার পথ দেয়া জরুরি।” [সর্বত্র অস্থিরতা। ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫। বর্ষ ৮ সংখ্যা ১৩। সাপ্তাহিক]
কিন্তু গণতান্ত্রিক বিকাশ তো আর এমনি এমনি হবে না। তার জন্য রাজনৈতিক দলকে গণতান্ত্রিক হতে হবে। সরকারি দলকে সরকারের অঙ্গীভূত না হয়ে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালাতে হবে, বিরোধী দলকে গণতান্ত্রিক পথে চলতে সহায়তা করতে হবে। সরকারি দলের তখন দায় অনেক। কিন্তু আমরা দেখলাম ঘটনা ঘটছে উল্টো। সরকারি দলের ভেতরে চলছে এক ব্যক্তির বন্দনা। ন্যায়-অন্যায় যাই হোক, সরকারি দলের সবার লক্ষ্য একটাই, যে কোন মূল্যে দলনেতার তুষ্টি ও সুদৃষ্টি অর্জন। তার মনোযোগ চাওয়াই সেসময় বড় নেতাদের একমাত্র রাজনৈতিক কর্তব্য।
আওয়ামী লীগ দলের প্রেসিডিয়াম মেম্বার হয়েছেন নূহ-উল-আলম-লেনিন। একসময়ের ছাত্র ইউনিয়ন করা লেনিন সাহেব তখন দলের হর্তাকর্তাদের একজন। তিনি লেখালেখি করেন। আওয়ামী রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অংশের সঙ্গেও জড়িত। তুলনামূলক ভদ্রলোক এই নূহ-উল-আলম-লেনিনের একটা সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হলো, “যুগের পর যুগ একজনের এভাবে দলের ও রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকা, স্বৈরনীতি গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে কিনা?”
নূহ-উল-আলম লেনিন উত্তরে বললেন, “আমি তা মনে করি না। এতে মানুষের নির্ভরশীলতা বা আস্থা আরও বাড়ে। এর ইতিবাচক দিক হচ্ছে, দলে বা দেশের মধ্যে শেখ হাসিনার যে অবস্থান তার কোনো বিকল্প নেই। তার প্রতি মানুষের আস্থা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী মানুষ আর ভাবে না।
আমাদের দেশের বাস্তবতায় শেখ হাসিনার মতো দৃঢ়চিত্তের নেতার খুবই দরকার ছিল বলে মনে করি। তিনি না এলে বাংলাদেশে কোনো দিন যুদ্ধাপরাধের বিচার হতো না। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব না থাকলে বিশ্বব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে পদ্মা সেতু হতো না। এ কারণে দলের নেতাকর্মী এবং দেশবাসীর কাছে অতিবিশ্বাসের নেতা শেখ হাসিনা। তিনি দল প্রধান এবং সরকারপ্রধান হলেও কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে নেন না। সবার সঙ্গে পরামর্শ করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র এমন যে, দলের প্রধান ইচ্ছা করলেই সব করতে পারেন না। তবে শেখ হাসিনা সততা এবং নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এমন আস্থা তৈরি করেছেন যে, তার সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার আর কোনো বাস্তবতা নেই।” [‘আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের আস্থা আছে’–নূহ-উল-আলম লেনিন, প্রেসিডিয়াম মেম্বার, আওয়ামী লীগ ১০ মার্চ ২০১৬। বর্ষ ৮ সংখ্যা ৩৯। সাপ্তাহিক।]
নূহ-উল-আলম লেনিনের এই ভাবনা তখন আওয়ামী লীগের অনেকেরই মনের কথা। তারা ধর্মবিশ্বাসের মত করে মনে করছেন, দলে বা দেশের মধ্যে শেখ হাসিনার যে অবস্থান তার কোনো বিকল্প নেই।
এই বিপজ্জনক ভাবনা যে, আজকের পরিণতিতে ঠেলবে সেকথা বহুভাবে বলা হলেও তা শোনার মত লোক তখন দল-সরকার-রাষ্ট্রে আর কোথাও নেই। এই দুর্ভাবনা আমাদের বিষণ্ণ করে ফেলেছিল। আমরা দেখছিলাম স্বাভাবিক নিয়মেই এই বল্গাহীন ক্ষমতা দল-সরকার-রাষ্ট্রকে একাকার করে রাষ্ট্রকেই নিপীড়ক বানিয়ে তুলছে। রাষ্ট্র তার সকল সহনশীলতা হারিয়ে বোধশূন্য হয়ে পড়ছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে উচ্চারণ করেছিলাম, “…আমরা দেখছি রাষ্ট্র ক্রমশ নিপীড়ক হয়ে উঠছে। তার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চাপ বা বলপ্রয়োগকেই কর্মনীতি হিসাবে গ্রহণ করেছে। কোনো কিছু রাষ্ট্রের মনঃপুত না হলেই রাষ্ট্র নিপীড়নকে তার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যকলাপ রাষ্ট্রের পছন্দসই না হলেই আইন-আদালত-পুলিশ-সরকারি রাজনৈতিক সংগঠন নিয়ে হামলে পড়ছে রাষ্ট্র। হালে একটি ইংরোজি দৈনিক সংবাদপত্রের সম্পাদককে নিয়ে রাষ্ট্র যে আচরণ করছে, তাকে কখনই রাষ্ট্রানুগ, ন্যায্যতানির্ভর আচরণ বলা চলে না। রাষ্ট্র তার বড় মন হারিয়ে ফেলছে। বুঝতে হবে ক্ষুদ্র মন, সংকীর্ণ হৃদয় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করলে, যতই উন্নয়ন শোরগোল তোলা হোক না কেন-তা গণতান্ত্রিক অবয়ব পায় না। ক্রমশ তা স্বৈরতান্ত্রিক বেদনাবহ আবহ তৈরি করতে থাকে।”[ছোট মন বড় জাতি অসম্ভব ভাবনা, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, বর্ষ ৮ সংখ্যা ৩৬, সাপ্তাহিক]