বয়স চুরি আর কত দিন
বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের জন্ম কোন তারিখে? চোখ বন্ধ করে দুটি তারিখ উল্লেখ করা যায়—১ জানুয়ারি এবং ৩১ ডিসেম্বর। বিষয়টি আগে চুপিসারে জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা শিক্ষাসনদে ঘাপটি মেরে থাকলেও এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বহুল ব্যবহারে প্রকট আকারে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ফেসবুক এই দুই তারিখেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পরামর্শ দেয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই দুই দিনেই এত বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্ম হলো কী করে? চটপট বলে দেওয়া যায়, ১ জানুয়ারি এবং ৩১ ডিসেম্বর যাদের জন্মতারিখ, তাদের অধিকাংশেরই প্রকৃত জন্মতারিখ এগুলো নয়। সাদা চোখে একজন মানুষের দুই জন্মতারিখের বিষয়টি খুব নিরীহ ধরনের ভুল কিংবা অপরাধ মনে হতে পারে। কিন্তু সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও ব্যক্তিজীবনে এই অপরাধ কিংবা তথাকথিত ভুলের প্রভাব অনেক বড়। কারণ, এটি একটি চুরি। একটি শিশুর জীবনের পথচলার শুরুতেই এই চুরি সংঘটিত হয়, তার অজ্ঞাতসারে। তার জীবন গড়ে ওঠে একটি চুরি, তথা মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে।
বাংলাদেশে অবশ্য বয়স চুরির এই বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’। অনেক অভিভাবকই বড়াই করে বলেন, তিনি সন্তানের মঙ্গলের জন্যই বয়স কমিয়ে দিয়েছেন। অনেক প্রাপ্তবয়স্কও পরবর্তী জীবনে (বড়াই করে না হলেও মনে মনে) অভিভাবককে ধন্যবাদ জানান এই বলে যে ‘ভাগ্যিস, বয়সটা চুরি করা হয়েছিল। এ কারণেই চাকরিতে ঢোকার সরকার-নির্ধারিত বয়সসীমা ফাঁকি দেওয়া যাচ্ছে!’ অবশ্য সবার ক্ষেত্রেই যে অভিভাবকই বয়স চুরি করেন, তা কিন্তু নয়। গত কয়েক দশকে আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জেনেছি, কেউ কেউ বড় হয়ে নিজেই নিজের বয়স কমিয়েছেন, আরও কিছু বেশি সময় চাকরি করতে। তবে আরেকটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই বেরিয়ে আসে, এই চুরি শুধুই চাকরিকাল বাড়ানোর জন্য নয়, এর পেছনে আরও স্বার্থ রয়েছে।
বাংলাদেশে বয়স চুরির বিষয়টি একেক মানুষের ক্ষেত্রে একেকভাবে ঘটে, বিভিন্ন কারণে ঘটে। অনেকের ক্ষেত্রে বয়স চুরির ঘটনাটি ঘটে পরিবারে। অভিভাবক মনে করেন, সন্তানের বয়সটা যদি এক-দুই বছর কিংবা নিদেন পক্ষে ছয় মাস কমিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তার শিক্ষাজীবন শুরু হবে অপেক্ষাকৃত পরিণত মস্তিষ্ক নিয়ে। আবার কেউ কেউ আরেকটু আগ বাড়িয়ে ভাবেন, বয়সটা একটু কমিয়ে দেওয়া গেলে সন্তান চাকরিতে প্রবেশের জন্য অপেক্ষাকৃত সময় ও সুযোগ বেশি পাবে। কেউ কেউ অবশ্য সন্তান বছরের শেষ দিকে কিংবা শুরুর দিকে জন্ম হওয়ায় ভাবেন, বছর শুরুর দিন-ক্ষণের সঙ্গে মিলিয়ে একটু বয়স কমিয়ে দিলে কী এমন হবে!
বয়স চুরি যে কেবলই বয়স কমাতেই করা হয়, তা-ও কিন্তু নয়। কেউ কেউ বয়স বাড়াতেও বয়স চুরি করেন। সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনের সুবাদে বয়স বাড়ানোর কিছু উদাহরণও আমরা জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেকে অংশগ্রহণকারী দাবি করে চাকরিক্ষেত্রে নিজের জন্য কিংবা সন্তানদের জন্য বিশেষ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ—এমনই কিছু উদাহরণ।
কিন্তু বয়স চুরির প্রভাবটা যদি গভীরভাবে ভাবা হয়, তাহলে পরিষ্কার হয়—এই অসততা একটি জাতির জন্য সামগ্রিকভাবে কতটা ক্ষতিকর। বয়স কাটাছেঁড়া করা প্রতিটা শিশুর জীবন দাঁড়ায় একটি মিথ্যার ওপর ভর করে। শিশুটি খানিকটা বড় হয়ে যখন এই সত্যের মুখোমুখি হয়, তখন সে হয়তো ধাক্কা খায়। তার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগে—‘আমার জন্মতারিখ দুটি কেন?’ কোনো শিশু হয়তো মুখ ফুটে এই প্রশ্ন করে না, তবে এ নিয়ে যে সে ভাবে না তা কে বলতে পারে! একটি শিশুর মস্তিষ্কে কত কত প্রশ্ন ঘোরে, তার কতটাইবা আমরা জানি। যে প্রশ্ন তাকে সবচেয়ে বেশি তাড়িত করে, সেটিই সে প্রকাশ করে। বাকি প্রশ্নগুলো তার মনে অনির্দিষ্টকালের জন্য রয়ে যায় জবাবহীন হয়ে। যদিও বয়স চুরি-সংক্রান্ত প্রশ্নটির জবাব কিছুটা বড় হয়েই (কৈশোরকালে) সে আপন মনে জেনে যায়।
একবার ভাবুন, যে শিশুর জীবনের শুরু এমন মিথ্যা দিয়ে, সে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের কাছ থেকে কী শিখবে? বড় হয়ে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রকে সে কী দেবে? অনেকে হয়তো যুক্তি তুলে ধরবেন, ‘আমারও তো বয়স কমানো হয়েছে, তাই বলে কি আমি অসৎ হয়ে গেছি?’ যিনি এই প্রশ্ন তুলবেন, তাঁকেও অনুরোধ করি—বয়স চুরির বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনিও কি মনে মনে গুটিয়ে যান না?
বয়স নিয়ে বিশ্বের অন্য দেশে কী ঘটে আমার জানা নেই। তবে আমাদের দেশে যা ঘটে, তা তুঘলকি। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এর কারণে নানা ঘটনা ঘটছে। প্রথমত, যে শিশুর বয়স চুরি করা হয়নি, সে শিক্ষাজীবনে প্রবেশই করে অপেক্ষাকৃত বয়সে বড় শিশুদের সঙ্গে। ফলে সহপাঠীদের সঙ্গে সেভাবে পেরে ওঠে না। এটা তার মনন-মানসিকতায় ভয়ংকর প্রভাব ফেলে। শিক্ষাজীবনের শুরুতে এমন নেতিবাচক অভিজ্ঞতার প্রভাব কিন্তু তার বাকি জীবনে রয়ে যায়। একইভাবে সরকার-নির্ধারিত বয়সসীমা পেরিয়ে যাওয়া একজন মানুষ যখন বয়স কমানোর সুযোগ নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেন, তিনি মূলত অন্য একজনকে বঞ্চিত করেন। আবার যিনি বিশেষ সুবিধা নিতে বয়স বাড়িয়েছেন, তিনি বা তাঁর সন্তানেরাও কিন্তু কাউকে না কাউকে বঞ্চিত করছেন। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এভাবে একটি শঠতার মাধ্যমে চাকরিতে ঢুকে যাওয়া মানুষটি তাঁর কর্মজীবনে কতটা সৎ থাকতে পারবেন? অবশ্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সম্প্রতি যে হারে বিভিন্ন রাজনীতিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করছে, তাতে মনে আরেকটি প্রশ্ন জাগতেই পারে—আমাদের দেশে সৎ মানুষ আছে তো?