কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার
বাংলাদেশের সূচনাকাল থেকেই সংবিধান নিয়ে বোদ্ধা, যোদ্ধা ও অবোদ্ধা মহলে একটা আলোচনা ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে। তবে এ সময় এসে তা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। সংবিধানবোদ্ধাদের একটি মহল মাঝে মাঝে ঝড় তুলছেন যে, সংবিধান সম্পর্কে জ্ঞান নেই, এমন লোকেরাই এখন সংবিধান নিয়ে কথা বলছেন। যোদ্ধারা বলছেন, মারো টান হে-ই-ও, ওটা উড়িয়ে দাও। বোদ্ধা-অবোদ্ধা কেউ কেউ বলছেন, সংবিধান গেল তো সবই গেল, এ জাতি রসাতলে গেল। অন্যরা বলছে, গত রেজিম সংবিধানকে পরিবর্তন করে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে; তাই সংবিধান সংশোধন করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হবে। এ আলোচনার তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে আমরা আমজনতা ভ্যাবাচ্যাকা খাচ্ছি! তাই মনে হলো আমজনতা হিসাবে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা দরকার।
সংবিধানের এত সংশোধনের পরও তো রাষ্ট্রে একজন নাগরিকের ‘সার্বভৌম’ সত্তা রক্ষা করা যায়নি। রাষ্ট্রের জননিরাপত্তা বাহিনী সরাসরি নাগরিকের বুকে বুলেট বসিয়ে দিয়েছে। তাহলে কে সার্বভৌম? নাগরিক, সংবিধান, না বুলেট? সংবিধানবোদ্ধাদের কাছে আমার এ বোকা প্রশ্নটা থাকল। কোনো একটা বৈঠকে আমি একটি প্রশ্ন তুলেছিলাম। প্রশ্নটা হলো, দেশের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী আইন কোনটি? আমার জ্ঞানের এত অভাব দেখে অনেকেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, কেন সংবিধান! একজন বললেন তিনি মানেন না যে, সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী আইন। সবাই তাকে চেপে ধরল, কেন কেন? তাহলে সবচেয়ে শক্তিশালী আইন কী? তিনি নির্বিকারভাবে বললেন যে, দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী আইন হলো ‘কিল’। সবাই তো তার ওপর আরও চটে গেল। ‘What nonsense you are talking about?’ কিল মানে কী? তিনি বললেন, ‘কিল’ মানে ‘কিল’ বা ‘ঘুসি’ বা মুষ্টিবদ্ধ হাতের আঘাত। তাকে রীতিমতো সবাই চেপে ধরল যে, ‘কিল-ঘুসি’ কী করে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইন হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করার জন্য। সে বলল তোমরা দেখ, গত দেড় দশক যাবত আমরা শুনে আসছি সংবিধানের বাইরে কিছু হবে না। সংবিধান লঙ্ঘন করলে মৃত্যুদণ্ড হবে। ’৭২ সাল থেকে শুনে এসেছি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান ’৭২-এর সংবিধান ইত্যাদি। ’৭২-এর সংবিধানের ধাঁচে ’৯১তে সংবিধান সংশোধন হলো। এত ভালো সংবিধান কি নাগরিকের বুকে বুলেট বিদ্ধ করা আটকাতে পেরেছিল? পারেনি তো! সংবিধানের বাইরে কিছু হবে না, এ কথা শুনতে শুনতে দেশের শিয়াল-শকুন, কাক-চিলেরা পর্যন্ত সংবিধান সংবিধান বলে চিৎকার শুরু করেছিল। কিন্তু জনগণ যখন একত্র হয়ে বুলেটের বিপরীতে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ‘কিল’ দেখাল, তখন গুলি বন্ধ হলো। মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীসহ শকুন-শিয়াল-কাক সবাই তো সংবিধান-ঢংবিধান ফেলে পালিয়ে গেল। সংবিধান কি তাদের পলায়ন থেকে রক্ষা করতে পেরেছিল? তাহলে সহজ হিসাব সংবিধানের চেয়ে বুলেট শক্তিশালী, তার চেয়েও শক্তিশালী জনতার ‘কিল’। সংবিধান না জনগণকে রক্ষা করতে পারে, না প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষা করতে পারে। কাজেই জনতার ঐক্যবদ্ধ কিলই সবচেয়ে বড় আইন বা বিধান। এ কথা শুনে আমরা সবাই তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। এমন অকাট্য যুক্তি, প্রতিযুক্তি দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেল না কেউই।
এ ঘটনা থেকে আমার মধ্যে সংবিধান সম্পর্কে একটু ঔৎসুক্য দেখা দিল। তাই এ সম্পর্কিত চলতি আলাপ-আলোচনা, সমালোচনাগুলো লক্ষ করতে থাকি। লেখালেখিগুলো একটু পড়ি। এ সম্পর্কিত তাত্ত্বিক সূত্রগুলো সম্পর্কে যৎসামান্য অনুসন্ধান করি। সংবিধান সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তার উৎপত্তি বা বিকাশ বেশি দিনের নয়। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভিত্তি থেকে আধুনিক রাষ্ট্র বিস্তারের সূত্রপাত। অতঃপর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়া পত্তন। এর আগে রাজা বা সম্রাটের সার্বভৌম আদেশের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালিত হতো। সে ব্যবস্থায় রাজা বা সম্রাটই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তার এ সার্বভৌমত্বের ভিত্তি ছিল উত্তরাধিকার, ঈশ্বরের প্রভুত্ব এবং রাষ্ট্রীয় সৈন্যবাহিনী; সর্বোপরি যোদ্ধা হিসাবে নিজের দক্ষতা এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় বিচক্ষণতা। এ একচ্ছত্র সার্বভৌমত্ব থেকে জন্ম নিত নিষ্ঠুর স্বেচ্ছাচার-স্বৈরাচার। ফরাসি দার্শনিকদের মধ্যে ভলতেয়ার, মন্টেস্কু এবং রুশো এ অবস্থা থেকে মানুষের মুক্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে যে তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করেন, তাকে কেন্দ্র করেই বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উন্মেষ ঘটে।
ভলতেয়ার শোনালেন গণতন্ত্রের একটি মূলমন্ত্র-‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত না হতে পারি; কিন্তু তুমি যাতে তোমার মত তুলে ধরতে পারো, আমি তার জন্য জীবনপণ লড়াই করে যাবো।’ রুশো বললেন সামাজিক চুক্তির কথা। মন্টেস্কু বললেন, সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্যমূলক বিভাজনের কথা। লিখিত বা অলিখিতভাবে আধুনিক রাষ্ট্রের এসব মূলনীতির চর্চাকে সাধারণভাবে সংবিধান বলা যায়। সুতরাং আধুনিক একটি রাষ্ট্রের সংবিধানের পেছনে রয়েছে তিনটি সত্তা, যথা : সার্বভৌমত্ব, সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্যমূলক বিভাজন এবং সম্ভাব্য ন্যায়নিষ্ঠ চর্চা। কাজেই সুন্দর সুন্দর শব্দের মালা গেঁথে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত বাক্য বিন্যাসে হীরক জহরতময় জ্বলজ্বল করা অধিকারগুলো চর্চা করা না হলে ওই সংবিধান একটি অথর্ব পুস্তক ছাড়া আর কিছুই নয়। কালির হরফে লিপিবদ্ধ সংবিধান আধুনিক রাষ্ট্রের একটি অতি নগণ্য অনুষঙ্গ মাত্র। এটি কোনো লক্ষ্য বা পূজনীয় সত্তা নয়। ব্রিটিশদের এখনো কোনো লিখিত সংবিধান নেই। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র আছে যাদের সংবিধান নেই। তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা কি চলছে না? পশ্চিমা সভ্যতা তো মুসলমানদের অনেক জিনিসই স্বীকার করে না। তারপর বিশ্বাসী হিসাবে আমাদের জেনে রাখা ভালো যে, ‘মদিনা সনদ’ই প্রথম লিখিত সংবিধান, যা সামাজিক চুক্তি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সংবিধান সংশোধন