রাজনৈতিক মতৈক্যের বিকল্প নেই
পাল বংশের উদ্ভবকালে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল, সে সময়ের বঙ্গবাসীর রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রজ্ঞা ও পরিপক্বতার তুলনায় আমরা সমসাময়িক বাংলাদেশে কিছু উন্নতি করতে পেরেছি কিনা, তা একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে চাই। আমাদের রাজনৈতিক মেধা ও পরিমণ্ডল কি ওই ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের সমমানের বা নিম্নমানের? এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন প্রখ্যাত অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ কর্তৃক রচিত ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থ থেকে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিচ্ছি : ‘তারনাথ গোপালের উত্থান সম্বন্ধে একটি রূপকথার কাহিনির অবতারণা করেছেন। তার কাহিনির সারমর্ম এই যে, দেশে বহুদিন ধরে অরাজকতার ফলে জনগণের দুঃখ-কষ্টের সীমা ছিল না। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মিলিত হয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে একজন রাজা নির্বাচিত করেন। কিন্তু নির্বাচিত রাজা রাত্রিতে এক কুৎসিত নাগরাক্ষসী কর্তৃক নিহত হন। এরপর প্রতি রাত্রিতে একজন করে নির্বাচিত রাজা নিহত হতে থাকেন। এভাবে বেশ কয়েক বছর গত হয়ে যায়। অবশেষে একদিন চুন্ডাদেবীর এক ভক্ত এক বাড়িতে আসে। সেই বাড়ির সবাই খুব বিষণ্ন। কারণ ওইদিন নির্বাচিত রাজা হওয়ার ভার পড়েছে ওই বাড়িরই এক ছেলের ওপর। আগন্তুক ওই ছেলের স্থানে রাজা হতে রাজি হন এবং সকালবেলা তিনি রাজা নির্বাচিত হন। সেই রাত্রিতে নাগরাক্ষসী এলে তিনি চুন্ডাদেবীর মহিমাযুক্ত এক লাঠি দিয়ে তাকে আঘাত করেন। রাক্ষসী মরে যায়। পরের দিন তাকে জীবিত দেখে সবাই আশ্চর্য হয়। পরপর সাত দিন তিনি এভাবে রাজা নির্বাচিত হন। অতঃপর তার অদ্ভুত যোগ্যতার জন্য জনগণ তাকে স্থায়ী রাজারূপে নির্বাচিত করে এবং তাকে গোপাল নাম দেওয়া হয়।’
এ রূপকথার উপরে বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার অনেক আবেগঘন আতিশয্য ব্যক্ত করেছেন, যার সঙ্গে ওই চার অধ্যাপক একমত নন। যা হোক, বাংলার ইতিহাস বিনির্মাণে খালিমপুর লিপির শ্লোকটি গুরুত্বপূর্ণ মর্মে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকরা মনে করেন। এ শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘মাৎস্যন্যায়’ অবস্থার অবসানের জন্য ‘প্রকৃতিগণ’ গোপালকে রাজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল। ‘মাৎস্যন্যায়’ শব্দের স্পষ্ট ব্যাখ্যা বা অর্থ থাকলেও ‘প্রকৃতি’ শব্দের তাৎপর্য বা রূপক বা আক্ষরিক কোনো অর্থই নির্ণয় করা যায়নি। তবে অনুমান করা হয়, ‘প্রকৃতিগণ’ বলতে উচ্চ শ্রেণির রাজকর্মচারী বা সমাজের উচ্চবর্গীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সমাজপতিরা। অধ্যাপকরা বিশ্লেষণ শেষে যে নির্ণয়ে উপনীত হয়েছেন, তা হলো, ‘গোপাল একজন সমর নেতা হিসাবে কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সহায়তায় অরাজকতার অশুভ শক্তিগুলোকে পরাস্ত করে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। সাফল্যই তার জন্য বিপুল সমর্থন জুগিয়েছিল।’ বঙ্গে বা এর বাইরেও ছোট ছোট রাজ্য বা জমিদারি নিয়ে এরূপ উপকথাও প্রচলিত আছে, জমিদার বা রাজা নিরুদ্দেশ বা কোনো যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তার উত্তরাধিকারী বা আমত্যজনদের মধ্যে এমন বিষম কোন্দল, কে রাজা হবে তা নির্ণয় করা যাচ্ছে না। পরে রাজার হাতিকে ছেড়ে দেওয়া হলো রাজা খুঁজে আনার জন্য। রাজহাতি সারা দিন অথবা ৭ দিন ভ্রমণ করে দীনহীন একজন রাখাল বা ফকির বা সাধুকে পিঠে করে নিয়ে এসে রাজবাড়ির সিংহ দরজায় দাঁড়াল আর রাজবাড়ির সবাই এবং পার্শ্ববর্তী প্রজা সবাই হইহই করে তাকে রাজা রূপে অভিষেক করে আবার স্বাভাবিক রাজ্যপাঠ শুরু করল। এরূপ রাজার শাসনে সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকল।
আমরা এ বঙ্গীয় ‘ব’দ্বীপের বাসিন্দারা এভাবে বা পাল বংশের উদ্ভবের যে পদ্ধতি, তার চেয়ে উন্নত কোনো পদ্ধতিতে শাসক বাছাইয়ের জন্য উপযুক্ত বা পরিপক্ব হয়েছি কিনা, তার হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। ৯০-এ এরশাদ পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে ‘গোপাল’ হিসাবে নিয়োগ করা হলো। তিনি একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দিয়ে আবার বিচার কাজে চলে গেলেন। ‘মাৎস্যন্যায়’ চলতেই থাকল। পরে ’৯৬-এ আবার সংবিধান সংশোধন করে একজন ‘প্রধান গোপাল’ ও আরও কিছু গোপালের সমন্বয়ে একটি সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা হলো। এরূপ গোপালেরা ৯৬ ও ২০০১-এর দুটো মীমাংসা ঠিকঠাকই করেছিলেন। এতে কারও কারও পোষাল না। তারা ‘গোপাল’ বাছাইয়ের নয়া ফন্দিফিকির করাতে ‘গোল’ বেঁধে গেল। অরাজকতার একদম চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেল। এবার দিশেহারা রাজহাতি নিজেই ছুটে বেরিয়ে গেল। অতঃপর একজন রাখাল আর একজন লাঠিয়াল খুঁজে নিয়ে এলো। তারা দুজন মিলে আরও কয়েকজন সাধু-সন্ন্যাসী-ফকির নিয়ে আপাত একটা জনস্বস্তির ব্যবস্থা করলেন। সাময়িক কিছুদিন ডান্ডা মেরে অরাজকতা ঠান্ডা করলেন। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারলেন না। দেশ আবার হিংস্র সরীসৃপের শাসনে ছেড়ে দিয়ে কেঁদে বাঁচলেন। এ হলো ১৯৯০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাপাত বা বিবর্তন।
২০০৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণকারী এক দঙ্গল হিংস্র সরীসৃপের মধ্যে থেকে বের হয়ে এলো এক ভয়ানক ‘নাগরাক্ষসী’, যার বিষাক্ত ছোবলে গোটা জাতি জর্জরিত হয়ে পড়ল। তার আগ্রাসী দংশনে জাতির প্রাণ যায় যায় অবস্থায় উপনীত হলো। বিধাতার অপার করুণায় জুলাই বিপ্লব আর আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ফলে ওই ‘নাগরাক্ষসী’ বিতাড়িত হলো। আমাদের প্রয়োজন হলো আবার একজন ‘গোপাল’র। ২০২৪ সালে এসে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের সমর নেতা, বিচক্ষণ ‘গোপাল’র স্থলাভিষিক্ত হলেন একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূস। তাহলে যদি আমার মতো একজন সাধারণ বুদ্ধির মানুষ এরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের সমসাময়িক যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রজ্ঞা ও পরিস্থিতি এবং তার ১২৭৫ বছর পরে ২০২৪ সালের বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রজ্ঞা, পরিস্থিতির মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? তা কি খুবই ভুল হবে? শুধু সময়, মানুষের সংখ্যা, দেহগত মানুষেরই হয়তো পার্থক্য আছে! আমার দৃষ্টি এর চেয়ে আর বেশি কিছু দেখতে পায় না। বাংলার পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা ‘গোপাল’ যেমন ছিলেন দক্ষ সমর নেতা, তেমনি ছিলেন বিচক্ষণ শাসক। আমরা ২০২৪ সালেও একজন কাঙ্ক্ষিত মানের শাসক পেয়েছি; কিন্তু তাকে ঘিরে ধরছে হাজারটা সমস্যা। তিনি এবং তার সহযোগীরা সংবিধান ও রাষ্ট্র সংস্কার করতে চান, যা একটি জনআকাঙ্ক্ষাও বটে। কিন্তু কীভাবে করবেন? রাজা গোপালের সময়ে ‘প্রকৃতিগণ’ তাকে প্রবলভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ের ‘প্রকৃতিগণ’ বোধের অসাধ্য, বিরূপ, বিষম। তারা কী চায় বোঝা ভীষণ দায়! তারা হয়তো ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘সাক্ষী গোপাল’ বানাতে চায়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনৈতিক পরিস্থিতি
- মতানৈক্য