গত ২১ জুলাই সোমবার ২০২৫ ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি শোকাবহ দিন। নানা কারণে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে এক ট্র্যাজেডিক দেশ। এখানে মারি-মন্বন্তরে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে, রাজনৈতিক বিক্ষোভ-আন্দোলনে, সড়ক দুর্ঘটনায় ও খুন-খারাবিতে মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যায় বেশুমার। দেশটির অনুন্নতি ও অনগ্রসরতা এসব ট্র্যাজেডির মূল কারণ। দেশটিতে যদি শিক্ষা সংস্কৃতিতে উন্নতি ঘটত, রাজনীতি হতো খাঁটি গণতন্ত্রসম্মত, নাগরিকদের শ্রেয়বোধ যদি উন্নত হতো, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে দেশটি যদি অগ্রসরমান হতো তাহলে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি সর্বাংশে না হলেও অনেকটাই কমে আসত।
গত সোমবারের ঘটনাটি অন্যসব ট্র্যাজেডিক ঘটনা থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে মঙ্গলবারের পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী নিহত হয়েছেন ২০, এর মধ্যে শিক্ষার্থী ১৭, শনাক্ত হয়নি ৭ লাশ এবং আহত ও দগ্ধ হয়েছেন ১৭১। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও অনেকে। এই ট্র্যাজেডিক ঘটনায় ২২ জুলাই মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়েছে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ১০টা নাগাদ সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩২। আল্লাহ না করুন, নিহতের এই সংখ্যা যেন আর বৃদ্ধি না পায়।
দৈনিক সমকালের প্রতিবেদক লিখেছেন, ‘স্কুল ছুটির আনন্দে মশগুল শিশুরা। আছড়ে পড়া যুদ্ধবিমান। পুড়ে যাওয়া কচিমুখ। মায়ের আর্তনাদ। বাবার নির্বাক ছোটাছুটি। স্বজনের মাতম। উদ্ধার কর্মীদের প্রাণান্তকর লড়াই। রাস্তায় রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। হাসপাতালে ডাক্তার নার্সদের ছোটাছুটি। রক্তের জন্য আবেদন...দুগ্ধদের ২৫ জনের অবস্থান আশঙ্কাজনক।...সোমবার, বেদনায় ভরা একদিন। রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজ অ্যান্ড স্কুল প্রাঙ্গণে ওঠা শিশুদের আর্তনাদে ভারি হলো পুরো শহর, দেশ।’
স্কুলের শিক্ষিকা পূর্ণিমা দাশ ফেসবুকে লিখেছেন, স্কুল ছুটি হয় দুপুর একটায়। এরপর ২ ঘণ্টা কোচিং। তাই কিছু ছাত্রছাত্রী স্কুলে ছিল। আর যাদের অভিভাবক তখনো শিশুদের নিতে আসেননি, তারাই কেবল অপেক্ষায় ছিলেন। ততক্ষণে ৮০ ভাগ বাচ্চা বাড়ি চলে গেছে।
পূর্ণিমা দাশ লিখেছেন, দুপুর ১টা ১০ কী ১৫ মিনিট হবে। একটি বিমান (বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান) এসে আছড়ে পড়ে স্কুলের হায়দার আলী ভবনে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। ওই ভবনে বাংলা ভার্সনের তৃতীয় থেকে পঞ্চম এবং ইংরেজি ভার্সনের ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বাচ্চাদের ক্লাশ হয়। আমিও ওখানে ক্লাশ নেই। ক্লাশ শেষ করে ঠিক যেখানে বিমান আঘাত করেছে ওই করিডর পার হয়ে শিক্ষকদের কক্ষে গেছি। তখনই ভয়ানক শব্দ। কিছু বোঝার আগেই দেখি ছোট ছোট বাচ্চা দৌড়ে আসছে। তাদের সারা গায়ে আগুন। সরেজমিন জানা গেছে, ভবনটির ১তলায় যেসব শিশু ও শিক্ষকরা ছিলেন, বিধ্বস্ত বিমানের আগুন শুরুতেই তাদের গ্রাস করেছিল। নিহতদের মধ্যে বিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ তৌকির ইসলামও রয়েছেন। গতকাল ছিল তার একক উড্ডয়ন। যুদ্ধবিমান নিয়ে একক উড্ডয়নের স্তরে আসতে বিমানবাহিনীর পাইলটদের কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ পর্যায় পর্যন্ত যেসব পাইলট পৌঁছাতে পারেন তাদের সংখ্যা খুব কম। প্রশিক্ষণের সময় কো-পাইলট অথবা প্রশিক্ষক বিমানে থাকেন। কিন্তু সলো ফ্লাইটের সময় ধরে নেওয়া হয় পাইলট যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠেছেন এবং তিনি এককভাবেই যুদ্ধবিমান চালাতে সক্ষম। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঢাকা নগরীর ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে গত সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে ঢাকা কুর্মিটোলার বিমানবাহিনী ঘাঁটি একে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ক্রটির সম্মুখীন হয়। এ অবস্থায় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগযোগ করলে তৌকিরকে ইজেক্ট করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তৌকির চেষ্টায় ছিলেন বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে যুদ্ধবিমানটিকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী ১টা ১৮ মিনিটে, অর্থাৎ উড্ডয়নের ১২ মিনিট পর যুদ্ধবিমানটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে আছড়ে পড়ে এবং এর মধ্য দিয়েই গত সোমবারের বিশাল ট্র্যাজেডিক ঘটনাটি ঘটে।
এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনার সময় শিশুদের রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী (৪৬)। বিমান বিধ্বস্তের সময় তিনি দূরে ছিলেন। আগুন দেখে ছুটে এসে শিক্ষার্থীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন। ১৫-২০ জন শিক্ষার্থীকে একাই বের করে নিয়ে আসেন এই শিক্ষিকা। এতে তার শরীর পুরোটাই পুড়ে যায়। শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়ে মারা গেছেন। জীবনদায়ী এ শিক্ষিকা। গত সোমবার রাতে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তিনি ছিলেন শিক্ষক জাতির মধ্যে অনন্য। মায়ের মমতায় ভালোবেসেছিলেন কচি শিক্ষার্থীদের। তাদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন মহৎপ্রাণ এই শিক্ষিকা। বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ এমন একজন শিক্ষিকাকে পেয়ে শত দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার মাঝেও গর্ববোধ করতে পারে। এমন মাহেরীন চৌধুরীর জন্ম হয় শতাব্দীতে একজন কী দুজন। মাহেরীন চৌধুরী ছিলেন এক ক্ষণজন্মা নারী। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুন।