
উজ্জ্বল হোক রাতের অর্থনীতি
রাজধানী ঢাকার রাতের অর্থনীতির এক নতুন উচ্চতায় যাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যমুনা ফিউচার পার্কের ‘ফুডকোর্ট’ তৈরি হওয়ার পর থেকে শহরের অনেক স্থানে এই ধারণাটি জনপ্রিয় হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে শহরের নানা স্থানে, যেমন মিরপুর ডিওএইচএসের প্রবেশমুখে, মিরপুর এক নম্বর ঈদগাহ মাঠের পাশে, উত্তরায় বউবাজার ফুডকোর্ট, কেরানীগঞ্জের শরীফ ফুডকোর্ট, বসিলার অদূরে মধুসিটি ফুডকোর্ট, পূর্বাচল ৩০০ ফিট রাস্তার পাশে নীলা মার্কেটসংলগ্ন ফুডকোর্ট অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছে। এগুলো বিশেষত সন্ধ্যায় পারিবারিক ও সামাজিক আড্ডার অন্যতম স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। এর সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে মেট্রোরেল-ব্যবস্থা। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকে দিয়াবাড়িসহ নানা স্টেশনের পাশেই নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন স্বাদের রকমারি রেস্তোরাঁ। উত্তরা মধ্য স্টেশনের পাশে ১৩ নম্বর লেক বরাবর নজরকাড়া রেস্তোরাঁ ও ফুডকোর্ট বানানো হয়েছে। শুধু ফুডকোর্ট নয়, জনপ্রিয় হচ্ছে স্ট্রিট ফুডের দোকানগুলোও।
রাতের আড্ডা, প্রেম নিয়ে গান : রাতের আড্ডা নিয়ে বা সন্ধ্যার পরে নারী-পুরুষের সময় কাটানো নিয়ে বাংলাভাষায় অনেক গান রয়েছে। তখন অবশ্য ফুডকোর্টের ধারণাটি ছিল না। তাতে কী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯৫৯ সালে দ্বীপ জ্বেলে যাই ছায়াছবিতে গেয়েছেন, এই রাত তোমার আমার, ওই চাঁদ তোমার আমার, শুধু দুজনের...। ষাটের দশকে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে, রাত নিয়ে সবচেয়ে বেশি রোমান্টিক গান রচিত হয়েছে ফরাসি ভাষায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম অভিসার নিয়ে, নিশিতে প্রেমের আঁকুতি নিয়ে ঢের গান লিখেছেন। অদিতি মহসিন গাইছেন : কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে, তখন তুমি ছিলে না গো ছিলে না। আর শ্রাবণী সেন আমাদের নিয়ে যেতে চাচ্ছেন অভিসারে...আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধু হে আমার! প্রেমপাগল কাজী নজরুল ইসলাম তো আরেক কাঠি ওপরে। হরিমতী দেবী সেই ১৯৩৪ সালে গাইলেন, আজ নিশিতে অভিসার তোমারই পথে, বনের পাড়ে নিরালায়...! আর এ যুগের মন মাতানো গায়ক মান্না দে গাইলেন: সুন্দরী গো, দোহাই, দোহাই, মান করে না, আজ নিশিতে কাছে থাকো না বলো না (কথা : পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়)। সান্ধ্য অর্থনীতি : উইকিপিডিয়া বলছে, সান্ধ্যকালীন অর্থনীতি বলতে যারা দিনের কর্মকান্ড শেষে বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করার পরে সন্ধ্যায় যে সব কাজে জড়িয়ে পড়েন সেগুলোকে বোঝানো হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে বিনোদন এবং রাতের জীবন (Night Life) যা সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু করে সকাল ৬টা পর্যন্ত চলতে পারে। সে হিসেবে ঢাকার পাইকারি কারওয়ান বাজার, শনির আখড়া ও শ্যামপুর বাজার এবং মিরপুর দিয়াবাড়ি পাইকারি বাজার উল্লেখযোগ্য। আমাদের আশপাশের দেশগুলোতে ডাইনিং, থিয়েটার, পাব এবং ক্লাব রাতের অর্থনীতির অন্যতম খাত হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে অপরাধ এবং অসামাজিক আচরণের ঘটনাগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে। রাতে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের কাজ বেড়ে যায়। ক্রান্তিলগ্নে রাতের ঢাকার উজ্জ্বল সম্ভাবনা : অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাতের ঢাকার অর্থনীতি দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি হতে পারে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণির মানুষের কর্মযজ্ঞের স্থান। রাজধানী শহরে সন্ধ্যার পরে সংঘটিত হয় নানা রকম অর্থনৈতিক কর্মকা-ের রিনিঝিনি। জমে ওঠে ইনডোর খেলাধুলার ক্ষেত্র। পাশ্চাত্য ও পূর্বের কিছু দেশের অনেক ধরনের সান্ধ্য বিনোদনের মডেল ক্রমে চলে আসছে আমাদের রাজধানী শহরে। এটির ভালো-মন্দ কী তা আজকের আলোচনায় নয়। ঢাকায় সৃজনশীল মানুষের সন্ধ্যার আড্ডার জায়গা ৭০ ও ৮০ এর দশকে ছিল স্টেডিয়াম মার্কেটের দোতলা (বিশেষত ম্যারিয়েটা বুকস)। পাকিস্তান আমলে জনপ্রিয় ও প্রয়োজনীয় বইয়ের দোকান সেখানে দিনমান আড্ডার জন্ম দেয়। পরে সেটি নিউ মার্কেটে এবং ’৯০-এর দশকে শাহবাগের আজিজ মার্কেটে চলে আসে। বিখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহদের এক সময় নীলক্ষেতের সরকারি ভাটিখানায় চরম আড্ডা ছিল। এগুলো অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক গুরুত্ব বহন করত। কারণ সরকারকে যথেষ্ট কর দিতে হতো। সেগুলো, এখন আর নেই। সেই জায়দা দখল করেছে অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের জন্য লাইসেন্সধারী ক্লাব ও বারগুলো।
আনুষ্ঠানিক খাতও ব্যস্ত থাকে রাতে : ঢাকায় নানা রকম শিল্পকারখানা বিশেষ করে পোশাক শিল্পকারখানা রাত ১০টা পর্যন্ত চালু থাকে। পিক সিজনে কাজ চলে সারা রাত, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিফটে কাজ হয় পোশাক কারখানায়। এছাড়া পরিবহন, রিকশা, সিএনজি, ট্যাক্সি ইত্যাদিও রাতের অর্থনীতিতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। রাতে বাড়ি ফেরার পথে কর্মব্যস্ত লোকজন মুদি দোকান, সুপার শপ, ওষুধের দোকান এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান থেকে তাদের দরকারি সামগ্রী কিনে থাকেন। এসব সেক্টরে কাজ করে লাখ লাখ মানুষ। এছাড়া আছেন স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, ডাক্তার, নার্স, গণমাধ্যমকর্মী ও বিভিন্ন অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ। আছেন ডেলিভারিম্যান, রাইড শেয়ারিং ইত্যাদি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কর্মী। সবশেষে দায়িত্বে আসেন রাতের নিরাপত্তাকর্মী। অফিস, মার্কেট, আবাসিক এলাকা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় তারা পাহারার দায়িত্বে থাকেন। রাত কেন প্রিয়? : সারা দিনের ক্লান্তিময় কাজের শেষে সন্ধ্যায় যখন মানুষ ঘরমুখো হতে চায়, ঠিক তখনই কে যেন গেয়ে ওঠে, ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার, মৌনতার সুতোয় বোনা, একটি রঙিন চাদর (ভূপেন হাজারিকা)’ অথবা, এই বৃষ্টি ঝরা রাতে চলে যেয়ো না (রুনা লায়লা)। তাই, কেউ বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়, কেউ যায় পানশালায়। এই যে রাতের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, তার গুরুত্ব এতটাই বেড়েছে যে অনেক শহরে এখন রাতের মেয়র নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাত্রিকালীন অর্থনীতি (Night Time Economy) দ্রুতই উল্লেখযোগ্য হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। আগেই বলেছি, অনেক খোলামেলা জায়গায় গড়ে উঠছে ফুডকোর্ট, চা-শরবতের দোকান, বিদেশি খাবারের বিশেষ রেস্তোরাঁ... ইত্যাদি। অর্থনীতিতে তৈরি হচ্ছে নতুন খাত, সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান এবং সর্বোপরি অর্থনীতিতে চাহিদা প্রসারিত হচ্ছে। ফলে বাড়ছে দেশীয় উৎপাদন (জিডিপি)। এগুলোর জন্য দরকার আমলাতান্ত্রিক জটিলা কমিয়ে এসব ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা। সহসাই ট্যাক্স-ভ্যাট বসিয়ে নতুন ব্যবসার টুঁটি চেপে ধরা উচিত নয়। রাতের সেবায় এগিয়ে এলো নাইটলাইফ অ্যাসোসিয়েশন : রাতের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও তার সৃজনশীল গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০১২ সালে স্পেনের বার্সেলোনা শহর প্রথম ‘ইন্টারন্যাশনাল নাইটলাইফ অ্যাসোসিয়েশন (আইএনএ)’ তৈরি করে। এটি বিশ্বের প্রথম অলাভজনক সংস্থা যা বিশেষভাবে নাইটলাইফ অর্থনীতির প্রধান অংশীদারদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য গঠিত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে রেস্তোরাঁ, বার, ক্লাব, ডিস্কো, লাউঞ্জ, হোটেল এবং নাইটলাইফ সেক্টরের সঙ্গে অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। ‘আইএনএ’ হলো সারা বিশ্বের নাইটলাইফ ব্যবসা সংস্থার একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, যার সদস্যদের মধ্যে পৃথিবীর সেরা ক্লাবগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ছয়টি মহাদেশের অন্তত ৩০টি দেশের নানা বিনোদন ক্লাব ও অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়েছে।
আমস্টারডাম ও আরও ৬০ শহরে আছেন রাতের মেয়র : মিরিক মিলান হলেন আমস্টারডাম শহরের প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রাঞ্জল আমস্টারডাম শহরের ‘রাতের মেয়র’ নির্বাচিত হন ২০১২ সালে। তিনি শহরের বিনোদন, নাইটলাইফ শিল্প, নগরের বাসিন্দা ও নির্বাচিত কর্মকর্তাদের নিয়ে একযোগে কাজ করেছেন। মজার বিষয় হচ্ছে, ‘নাইট মেয়র’ শহরের প্রকৃত মেয়রের মতো কোনো সরকারি কর্মকর্তা নন। তিনি আসলে একটি স্বাধীন অলাভজনক সংস্থার প্রধান যিনি শহরের নাইটলাইফকে সুস্থ, প্রাণবন্ত এবং নিরাপদ রাখার জন্য কাজ করে থাকেন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক নগরের নীতিমালাভিত্তিক সংস্থা অনুসারে, এ বছরের জুলাই অব্দি বিশ্বব্যাপী ৬০টিরও বেশি শহরে রাতের মেয়র রয়েছেন। তারা রাতের সময়ের অর্থনীতি পরিচালনা এবং কার্যক্রম প্রচারের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নাইট মেয়র’ পদ বা সমতুল্য প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করেছেন। করোনা মহামারীর সময়ে (২০২০ সালে) মাত্র ১২টি মার্কিন শহর রাতের মেয়র ছিলেন যা ২০২৩ সালের মধ্যে ৫০টিরও বেশি শহরে এই পদটি ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও মেয়রের পরিবর্তে শহরগুলো ‘নাইট কমিশনার’, ‘নাইটলাইভ বিজনেস অ্যাডভোকেট,’ ‘রাত-দিনের অর্থনৈতিক রাষ্ট্রদূত’ প্রভৃতি নাম দেওয়া হয়েছে। যেমন, ইউরোপের লন্ডন, প্যারিস, জুরিখ, বার্লিন এবং বার্সেলোনায় এ বছর প্রথম ‘নাইট কমিশনার’ নিযুক্ত করেছে। রাতের মেয়র ধারণাটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দলীয়ভাবে এটিকে সমর্থন করে সামগ্রিক নগর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে এটিকে সংযুক্ত করেছেন। রাজস্ব উৎপাদন করে চলেছে রাতের শহর : ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী সান্ধ্যকালীন অর্থনীতির বাজারের আকার ছিল ১.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩৩ সালের মধ্যে ২.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, গবেষণা করে বলছে বিবিসি-সহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। নিউ ইয়র্ক শহরে বার্ষিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাজ্যে ৮৫ বিলিয়ন পাউন্ডের অর্থনৈতিক কর্মকা- রাতের অর্থনীতিতে অবদান রাখে। শুধু লন্ডনে এর পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন পাউন্ড। রাত এখন দিনের কর্মযজ্ঞের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। এদিকে, সিডনি ও নর্থ সাউথ ওয়েল্স জোনে বার্ষিক প্রায় ১০২ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলারের সমপরিমাণ অর্থনৈতিক কর্মকা- হচ্ছে যা সিডনির ক্ষেত্রে প্রায় ৫.৭ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্ট্রিট ফুড
- ফুডকোর্ট