
‘আমি বেঁচে থেকেও প্রতিদিন মরতাম’
নারী—একজন মেয়ে, একজন স্ত্রী, একজন মা—পরিবার নামক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে যার অবস্থান। অথচ অনেক সময় সেই পরিবারেই সে পরিণত হয় নিপীড়নের শিকার। পরিবার যেখানে নারীর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হওয়ার কথা, সেখানে সে অনেক সময় ভোগ করে ভয়, অপমান, অবহেলা এবং নিঃশব্দে চালিত সহিংসতার চরম রূপ।
এই নির্যাতন শুধু শারীরিক নয়, আরও গভীর, আরও ক্ষতিকর। পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতা মানসিকভাবে তাকে ভেঙে ফেলে, আত্মবিশ্বাস হরণ করে এবং একসময় সে নিজেকেই অপ্রয়োজনীয় মনে করতে শুরু করে। বারবার কটূক্তি, অবহেলা, সিদ্ধান্তে অংশ নিতে না দেওয়া, কিংবা উপার্জন নিয়ন্ত্রণ—এসবই এক ধরনের সহিংসতা। অনেক সময় নারীরা বিবাহিত জীবনে সম্মতি ছাড়াই শারীরিক সম্পর্কের শিকার হন, যা আইনগতভাবে ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে। সন্তানের সামনে এসব ঘটতে থাকলে তারা বেড়ে ওঠে এক বিষাক্ত মানসিক পরিবেশে, যা সমাজের ভবিষ্যৎকেও বিপন্ন করে তোলে।
এই পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে বহু যুগের লালিত পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাধারা, যেখানে নারীকে পরিবারে গৃহস্থালির দায়িত্বে নিয়োজিত এক ‘নির্বাক সঙ্গী’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হলে নারীরা পরিবারে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেন না। আবার যারা প্রতিবাদ করতে চান, তারা সমাজের চোখ রাঙানি, লোকলজ্জা আর বিচারহীনতার শিকার হন। অনেক সময় নারী নিজেই চুপ করে যান, এই ভেবে যে ‘বাড়ির সম্মান’ বা ‘সন্তানের ভবিষ্যৎ’ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
তবে একটি সত্য দিনের আলোর মতো স্পষ্ট—যে পরিবারে নারী নিরাপদ নয়, সেখানে কোনো শান্তি, মমতা বা সুস্থ সামাজিক বন্ধন গড়ে ওঠে না। একজন নির্যাতিত নারী শুধু নিজের ক্ষতি নয়, পুরো পরিবারের ভারসাম্য নষ্ট করে দেন, যদিও এতে তার কোনো দোষ থাকে না। কারণ তিনি বেড়ে ওঠেন ভয়ের মধ্যে, সন্তানদেরও সেই ভয়, আতঙ্ক আর সহিংসতা দেখে বড় হতে হয়। ফলে পুরো প্রজন্মই বেড়ে ওঠে বিকৃত বাস্তবতায়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, সে বছর দেশে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ জন নারী, যার মধ্যে অধিকাংশই স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের হাতে নিপীড়িত। রাজধানী ঢাকায় আলোচিত এক ঘটনায় দেখা যায়, এক গৃহবধূ নিয়মিত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন, আর মৃত্যুর আগে সামাজিক মাধ্যমে রেখে যান একটি মর্মস্পর্শী বার্তা—‘আমি বেঁচে থেকেও প্রতিদিন মরতাম।’
এ ধরনের ঘটনা কেবল বিচ্ছিন্ন নয়—বরং প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটে চলছে এমন অসংখ্য অঘটন, যার অধিকাংশই চাপা পড়ে সমাজের লোকলজ্জা ও নীরবতা নামক দেওয়ালে। মানসিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, যৌন নিপীড়ন, সন্তানকে ব্যবহার করে মানসিক চাপ দেওয়া—সব কিছুই আজ নারীর দৈনন্দিন বাস্তবতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও সরকার ২০১০ সালে গৃহস্থালি নির্যাতন (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন প্রণয়ন করেছে, চালু করেছে ১০৯ নম্বর হেল্পলাইন, নারী সহায়তা কেন্দ্র ও নিরাপদ আবাসন সুবিধা, কিন্তু অনেক নারী এসব সেবা সম্পর্কে অবগত নন। যারা জানেন, তারাও ব্যবহার করতে ভয় পান কিংবা প্রতিকূলতা ও বিচারহীনতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে পরিবারে নারী নির্যাতনকে এখনো ‘পারিবারিক বিষয়’ বলে চেপে যাওয়া হয়।
এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। কারণ নারী কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রজন্মের ভরকেন্দ্র। একটি সহিংস পরিবারের সন্তান বড় হয় আতঙ্ক, ঘৃণা আর সহিংসতা দেখে, যা প্রভাব ফেলে তাদের মানসিক বিকাশ ও সামাজিক আচরণে। সমাজ যদি নারীর সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে সেই সমাজের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।