
ট্রাম্পের শুল্কঝড় ও বাংলাদেশের অবস্থান
২ এপ্রিল ২০২৫ ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নতুন শুল্কনীতিতে সারা বিশ্ব থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক ধার্য করেন, যা বিভিন্ন দেশের সাথে তাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের আলোকে রেসিপ্রোকাল বা পাল্টা শুল্কারোপ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তি তাদের আরোপিত নতুন শুল্কহার অন্য সময়ের চেয়ে অধিক হলেও তা মার্কিন পণ্যের ওপর বিভিন্ন দেশ কর্তৃক আরোপিত শুল্কহারের চেয়ে কম। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটা বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হয়।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর ওপরও এই শুল্কহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও তা অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় কম, যা থেকে যে বিষয়টি বিষয় সামনে চলে আসে তা হচ্ছে বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে একে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের এই নতুন শুল্কনীতি ঘোষণার কয়েকদিনের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে একে ৩ মাসের জন্য স্থগিত করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে এই বিষয়ে দরকষাকষির একটি নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়, যা ৯ এপ্রিল ২০২৫ উত্তীর্ণ হয়েছে এবং এদিন বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের জন্য তাদের সংশোধিত শুল্কনীতি প্রকাশ করা হয়।
এই শুল্কনীতিতে পূর্বের, অর্থাৎ এপ্রিল মাসে আরোপিত শুল্কের চেয়ে মাত্র ২ শতাংশ শুল্ক হ্রাস করে তা ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, এর আগে যা ছিল ১৫ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে এক্ষেত্রে ৩ মাস সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একাধিকবার আলোচনা এবং দেনদরবার করার পরও আমরা খুব বেশি অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য জানিয়েছে যে আলোচনার দরজা এখনো খোলা আছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন করে এই শুল্কহার হ্রাসের বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য। সঙ্গত কারণেই মার্কিন নতুন শুল্কহার আমাদের জন্য দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক আয়ের খাত তৈরি পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। তৈরি পোশাকের বাইরেও বাংলাদেশ চামড়াজাত পণ্য, টেক্সটাইল, সিরামিক, হিমায়িত পণ্য, চিংড়ি, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে আসছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ ৮৭৬ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে যুক্তরাষ্ট্রে যা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০৯ কোটি ডলার বা ১৪ শতাংশ বেশি। এই ৮৭৬ কোটি ডলারের মধ্যে কেবল তৈরি পোশাক রপ্তানি বাবদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আয় হয়েছে ৭৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ বর্ধিত আয় হয়েছে, তা ৫৪টি দেশের মোট রপ্তানি আয়ের সমান। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কহার বাংলাদেশের রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতকে কতটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। এই সময়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো, যারা তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী সেগুলো হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি।
সম্প্রতি তাদের সংশোধিত শুল্কহার থেকে দেখা যায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মালয়েশিয়ার ওপর থেকে পাল্টা শুল্ক উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস হয়ে তা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। অপরাপর দেশগুলো এখনো আলোচনা চালিয়ে চাচ্ছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে চীনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র মূলত তাদের এই পাল্টা শুল্কনীতি প্রণয়ন করেছে, সেই চীনের সাথে তাদের সাম্প্রতিক আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এবং উভয়পক্ষই কিছু ছাড় দিয়ে একে অপরের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক চালিয়ে নিতে অনেকটাই একমত হয়েছে। তবে তা কোনোভাবেই বাংলাদেশের চেয়ে কম হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি
- শুল্ক আরোপ