সংস্কৃতি ও সংগ্রামে চাই ব্যবস্থার বদল
উদীচী একটি সংগ্রামের নাম। ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ ১৯৬৯-এর প্রাক পর্বে ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর এই সংগঠনের জন্ম। জন্মের পর থেকেই তাকে লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫-এর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং তৎপরবর্তী সংকট, ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান, যুদ্ধাপরাধ বিরোধী সংগ্রাম, সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন, ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানসহ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় সংগঠিত যেকোনো আন্দোলনে উদীচীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। আজ সেই উদীচীর ৫৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সংগ্রামমূখর এই যাত্রায় নানাপর্বে যারা সহযাত্রী হয়েছেন তাদের সকলকেই অভিনন্দন।
সংগ্রামমূখর এ পথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তাকে পেরোতে হয়েছে বন্ধুর ও পঙ্কিল পথরেখা। আঘাত এসেছে বারে বারে। কখনো তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, কখনো হত্যা-হামলা করে অবরুদ্ধ করা হয়েছে পথ। কিন্তু উদীচী থেমে থাকেনি কখনো। বারবার ফিরে এসেছে দধীচীর সন্তান হয়ে। যুক্ত থেকেছে মানবমুক্তির সংগ্রামে। কিন্তু আসেনি মুক্তি। ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি তা অর্জিত হয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি শোষণহীন সমাজ, জনগণের রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক প্রগতি ও উন্নতির আকাঙ্ক্ষায় সংগঠিত হয়েছিল। কথা ছিল সামাজিক যে বৈষম্য বিরাজমান তা দূরীভূত হবে।
কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে ওই সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বারে বারে ছাত্র-শ্রমিক-জনতাকে অকাতরে জীবন দিতে হচ্ছে। বৈষম্যহীন সমাজ অর্থাৎ যেখানে জনগণ অর্থনৈতিক উন্নতির সামগ্রিক সুফল পাবেন এবং জনগণের কাছে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রত সরকার জবাবদিহিতা করতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু তা যে কেবল অপূর্ণ রয়ে গেছে তা নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে সরকার পতনের পর তা আরও দৃশ্যমান হয়েছে। কিছু কিছু মানুষ অসীম সম্পদের মালিক, আর কিছু মানুষ অর্থাভাবে ক্ষুধার জ্বালায় বিনিদ্র রাত্রী যাপন করছে। যাদের অর্থ আছে তাদের বিছানার নীচেও কোটি কোটি কোটি টাকা। এদের গাড়ি-বাড়ির হিসেব নেই। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিশ্বজুড়ে শুধু বাড়ির সংখ্যাই ৬০০।
শুধু আয় বৈষম্যই নয়, ভোগের, শিক্ষার, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, এমনকি অঞ্চলভেদেও বৈষম্য বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের যে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তার সাথে ক্রমবর্ধমান এই বৈষম্য কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ না। গণঅভ্যুত্থানে মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে একটা পটপরিবর্তনের হাওয়া বইছে। জনগণের মনে আকাঙ্ক্ষা ও শঙ্কা দুই-ই কাজ করছে। তার কারণ হয়তবা মানুষ যে রাজনৈতিক-সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল তা থেকে বের হতে না পারার দ্বিধা এবং যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে তারাও বিগত আড়াই-তিন মাসে এমন কিছু দেখাতে পারেনি, যা দেখে জনগণ আশান্বিত হতে পারে। জনগণের মৌলিক সমস্যা নিয়ে কোনো আলোচনা বা তর্ক-বিতর্ক নেই। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন নেই, জনগণের অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও অবহেলিত।
আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা এবং ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা একটা সুতায় না বাধতে পারি তাহলে অন্য আরও পাঁচটি আন্দোলনে রক্তদানের মতো এ আন্দোলনও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। আমাদেরকে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা তা পূরণে কাজ করতে হবে। আমরা যদি সেটা করতে ব্যর্থ হই তাহলে পরিকল্পনাবিহীন, অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ইট-কাঠ-পাথরের উন্নয়নে মানুষের মুক্তি আসবে না। যেখানে প্রয়োজন হবে পরমত সহিষ্ণুতা, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির। প্রয়োজন হবে ব্যবস্থা বদলের লড়াই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা এসেছে, তাদের প্রত্যেকে প্রত্যেকেই পুঁজির দাস। এর কেউই মানুষকে প্রকৃত মুক্তির স্বাদ দিতে পারেনি। এরা প্রত্যেকেই ক্ষমতার পালা বদলে বিশ্বাসী, লুটপাট এদের মজ্জাগত। যার নমুনা আমরা আবারও দেখতে শুরু করেছি। বিগত সরকারের সময়েও চর দখলের ঘটনা অবলোকন করেছি বর্তমানেও গ্রামে-গঞ্জে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ব্যাংক-বীমায় সর্বত্র একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে শুরু করেছে।