অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপ দেওয়া উচিত
জাতীয় সরকারের ধারণা বিশ্ব তো বটেই, বাংলাদেশেও নতুন নয়। ২০২১ সালে এ রকম একটি সরকার গঠনের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত সেটি আলোর মুখ দেখেনি। সাধারণভাবে জাতীয় সরকার বলতে বোঝানো হয় এমন একটি সরকারকে, যারা দৃশ্যত জনগণের স্বার্থে কাজ করে এবং দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য তৈরি করে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে।
যুক্তরাজ্যে ১৯৩০-এর দশকে অর্থনৈতিক সংকটের সময় একটি জাতীয় সরকার গঠিত হয়েছিল। এই সরকার মূলত বিভিন্ন প্রধান রাজনৈতিক দল যেমন লেবার পার্টি, কনজারভেটিভ পার্টি ও লিবারেল পার্টির মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল। এই সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালিতে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হয়েছিল, যাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর দেশ পুনর্গঠনে সহযোগিতা করতে পারে। এপার্থাইডের অবসানের পর দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠিত হয়েছিল, যাতে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস, ন্যাশনাল পার্টি এবং ইনকাথা ফ্রিডম পার্টির সদস্যরা অংশ নেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল, কারণ দক্ষিণ আফ্রিকা জাতিগত এবং রাজনৈতিক বিভক্তি থেকে বেরিয়ে আসছিল।
তার মানে জাতীয় সরকার হচ্ছে কোনো একটি দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে গড়ে তোলা একধরনের বহুদলীয় সরকার। সেই অর্থে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছে, সেগুলো জাতীয় সরকার নয়। কেননা ওই সরকার পরিচালনার সঙ্গে ছিলেন মূলত সাবেক সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, লেখক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী তথা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। অর্থাৎ এটি নির্দলীয়। নির্দলীয় সরকারকে জাতীয় সরকার বলার সুযোগ নেই। ২৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে নাগরিক অধিকার-বিষয়ক সংগঠন ব্লাস্টের আয়োজনে সংবিধান সংশোধন ইস্যুতে একটি আলোচনায় একজন সিনিয়র আইনজীবী এই সরকারকে বলেছেন ‘ভালো মানুষের সরকার’।
বাস্তবতা হলো, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ভালো মানুষের চেয়েও বেশি দরকার যোগ্য ও দক্ষ মানুষ। একজন শিক্ষক ক্লাসে যতই ভালো পড়ান না কেন; একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী যত মানবিক ও সৎ মানুষ হোন না কেন; একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা যতই দুর্নীতিমুক্ত হোন না কেন—দিন শেষে রাষ্ট্র পরিচালনা একটি বিরাট রাজনৈতিক যজ্ঞ। তবে নাগরিক সমাজের মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার মতো যোগ্য ব্যক্তি নেই, এমনটিও বলার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যাঁরা এবারের অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন—এখন পর্যন্ত তাঁদের কারও ব্যক্তিগত দুর্নীতি বা অসততার অভিযোগ না উঠলেও বা তাঁদের ট্র্যাক রেকর্ড ভালো হলেও কারও কারও যোগ্যতা, বিশেষ করে মন্ত্রণালয় চালানোর মতো দক্ষতা আছে কি না—তা নিয়ে জনপরিসরে আলোচনা আছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান সম্প্রতি একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলে বলেছেন, ‘একজন আমলা যদি শয়তান হয়, তাহলে সে এক শ ইবলিসের চেয়েও বড় ভয়ংকর।’ কথা হচ্ছে, এ রকম আমলা কি এখনো নেই? তাঁদের সঙ্গে পেরে ওঠার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে শুধু ভালো মানুষ হলেই চলবে না, শয়তানের শয়তানি ধরতে পারার মতো কৌশলও তাঁর জানা থাকা দরকার। এটি ভালো বোঝেন রাজনীতিবিদেরা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যদিও রাজনীতিবিদেরা, বিশেষ করে মন্ত্রী-এমপিরা অনেক বেশি আমলানির্ভর হয়ে গিয়েছিলেন। তার কারণ অযোগ্য লোকদের এমপি-মন্ত্রী হওয়া। কিন্তু যখন যোগ্য লোকেরা এমপি-মন্ত্রী হতেন, তখন আমলারা তটস্থ থাকতেন। অতএব এখন অন্তর্বর্তী সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁরা বদিউর রহমানের ভাষায় ‘ইবলিস আমলাদের’ কতটা বাগে আনতে পারছেন বা পেরেছেন—সেটি বিরাট প্রশ্ন। কারণ, এরই মধ্যে গণমাধ্যমে অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে যে পুলিশ এখনো সেভাবে সক্রিয় হয়নি। প্রশাসনেও যে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে, সেটিও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তাহলে সমাধান কী? সমাধান জাতীয় সরকার।