
বেদনা ও বিদ্রোহ মিলিয়েই বাঙালি সংস্কৃতি
বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে বিকল্পটা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মতাদর্শিক। এর জন্য দরকার পড়বে সামাজিক বিপ্লবের। প্রতিটি দেশেই। যেটা স্থানীয়ভাবে গড়ে তোলা চাই, তবে তার চরিত্রটা অবশ্যই থাকবে আন্তর্জাতিক। পুঁজিবাদ যেমন আন্তর্জাতিক, তার বিকল্পও হওয়া দরকার তার চেয়ে গভীরভাবে আন্তর্জাতিক। সমাজবিপ্লবের জন্য খুব বেশি করে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক অনুশীলনের ও প্রস্তুতির। সাহিত্য, সংগীত, খেলাধুলা, আলোচনা-বিতর্ক, নাটক, নৃত্য, প্রচারমাধ্যম—সবকিছুর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক কাজটা এগিয়ে নেওয়া আবশ্যক।
পুঁজিবাদ ওই কাজকেই বিশেষ রকমের কঠিন করে তুলেছে। বৈশ্বিক এই আদর্শের কাছে সবকিছুরই ওজন হয় মুনাফার বাটখারায়। সংস্কৃতির চর্চাকেও সে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করতে তুমুলভাবে আগ্রহী। স্পর্শমাত্র পণ্যে পরিণত করার ক্ষমতা সে রাখেও। সংস্কৃতির বাণিজ্যিক চর্চার বিপক্ষে এবং মানবিক চর্চার পক্ষে আজ দাঁড়ানো চাই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংস্কৃতির মানবিক চর্চারই অপর নাম সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা।
পুঁজিবাদ মনেপ্রাণে সংস্কৃতির এই চর্চার বিরোধী। সংস্কৃতিচর্চা বিনোদন সরবরাহ করবে, এটা ঠিক আছে। অশ্লীল হলে তো আরও ভালো। তাতে বাণিজ্য জমবে এবং তার চেয়ে বড় একটা প্রাপ্তি ঘটবে, সেটা হলো মানুষকে সামাজিক বিপ্লববিরোধী করা যাবে। বিপ্লববিরোধিতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার চমৎকার নিদর্শন এখন পাওয়া যাচ্ছে সর্বাধিক উন্নত-বলে-কথিত আমেরিকায়। সেখানে শ্বেতশ্রেষ্ঠত্ববাদী উন্মত্ততা এমন পর্যায়ে উঠেছে যে ভিন্ন বর্ণের মানুষকে হত্যা শুরু হওয়ার দশা। এবং ওই বর্ণশ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নির্বাচনে তাঁদের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই জিতিয়েছেন এবং তাঁর বিজয়ে বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসী তৎপরতা ক্রমাগত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
পুঁজিবাদ গভীর ধরনের সাহিত্যের চর্চা একেবারেই পছন্দ করে না। সে জন্য দেখছি পাঠককে যে-সাহিত্য ধাক্কা দেয়, চিন্তিত করে, বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, তার প্রচার নেই, বাজারও নেই। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি অত্যন্ত সম্মানজনক ঘটনা। সেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল বব ডিলানকে, যিনি উঁচু মানের একজন সংগীত রচয়িতা এবং সংগীতশিল্পী অবশ্যই, কিন্তু নিজেকে তিনি সাহিত্যিক
বলে মনে করেন না, যে জন্য পুরস্কার গ্রহণে তাঁর রীতিমতো দ্বিধা ছিল। এর পরে এক বছর তো পুরস্কার দেওয়াই হলো না দাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ থাকার কারণে। তবে অন্তরালে যা-ই থাকুক, সামনে থেকে তো বোঝা যাচ্ছে সাহিত্যচর্চা তার আগের, এবং সর্বকালের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু সাহিত্য তো থাকবে। এই পৃথিবীতে মানুষ যত দিন থাকবে, ঠিক তত দিন সাহিত্যও থাকবে। কারণ, সাহিত্য মানুষের মনুষ্যত্বকে ধারণ ও লালন করে। কিন্তু সে জন্য সাহিত্যকে গভীর হতে হবে, মনভোলানোর ছলাকলানির্ভর হলে চলবে না। যাকে আধুনিক যুগ বলা হয়, সে-কালে আওয়াজ উঠেছে ‘আনন্দের সাহিত্য চাই’, কেউবা আবার ঘোষণাই দিয়েছেন, সহেনা সহেনা প্রাণে জনতার জঘন্য মিতালী। উদারনীতিক যিনি, তিনি বলেছেন, অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি নিশ্চয়ই আছেন, যিনি মেলাবেন ঝোড়ো হাওয়াটায় ও পোড়োবাড়িটায়।
মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী কবিও চেষ্টা করেছেন বিপ্লবী মার্ক্সের সঙ্গে ঘোরতর রক্ষণশীল টি এস এলিয়টের মিলন ঘটানোর। এসব কাজ সাহিত্যকে গভীরতা দেয়নি, এমনকি সাহিত্যের গুরুত্বকে যে দৃশ্যমান করবে, সে কাজটাও করতে পারেনি। সুবিধা হয়েছে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির চর্চার। এটা বোধ করি মানতেই হবে, বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতিতে একধরনের বিষণ্নতা বিরাজ করছে। গাছপালা, নদ-নদী, অর্থনীতির কৃষিনির্ভরতা, বহুকালের খাদ্যাভ্যাস—সবকিছু নরম ধরনের। মাংসের চেয়ে মাছ ও শাকসবজি এখানকার মানুষের অধিক পছন্দ। তারা স্বল্পে সন্তুষ্ট। কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাঙালি সংস্কৃতি