নদী খুন করে বন্যার জন্য কান্না!
দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলায় চলমান বন্যাকে অনেকেই অস্বাভাবিক বলছেন। বন্যার কারণ নিয়ে নানাজন নানা বিশ্লেষণ দিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নদীমাতৃক দেশের নদীগুলো ঠিক থাকলে কোনো বন্যাই কি আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হতো?
কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চলের নদী, খাল, জলাশয় ও নিম্নাঞ্চলগুলোয় পানির ধারণ ক্ষমতা কেমন? উজানের দেশ ভারত থেকে আসা পানির কারণে হোক কিংবা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অতিবৃষ্টির কারণে—বন্যা হলে সেই পানি এসব জলপথ ধরে সমুদ্রে চলে যাওয়ার মতো অবস্থা কি আছে? বহু বছর ধরে যে পানি ধরে রাখার জন্য রিজার্ভার তৈরির আলোচনা আছে, সেটি কি আদৌ আলোর মুখ দেখবে?
অতএব কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনীসহ আশেপাশের এলাকায় বন্যা চলাকালীনই এই বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। নদী, পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের জানমাল বাঁচানোর ইস্যুতে আত্মসমালোচনাও জরুরি।
কেমন আছে কুমিল্লা ও ফেনীর নদী?
বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু খবরের দিকে নজর দেওয়া যাক।
১. কুমিল্লার গোমতী নদীর সংযোগ থেকে চাঁদপুরের মেঘনা নদীর সংযোগ পর্যন্ত প্রায় ৬০-৬২ মাইলজুড়ে ডাকাতিয়া নদীর অবস্থান। শুকনো মৌসুমে এ নদী প্রায় পানিশূন্য হয়ে যায়। কুমিল্লার লাকসাম, লালমাই-মনোহরগঞ্জ উপজেলা হয়ে লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর জেলা পর্যন্ত মাইলের পর মাইল এলাকাজুড়ে কচুরিপানা ও পলি মাটি জমে ভরাট হয়ে গেছে। তার ওপর ডাকাতিয়া নদীর দুইপাড়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের জবরদখল। শুকনো মৌসুমে নদী, খাল, বিল, পুকুর, জলাশয়, ডোবা পানিশূন্য থাকে। অর্ধশতাধিক খাল জবর দখলের কারণে মৃতপ্রায়।
২. কুমিল্লার খরস্রোতা গোমতী নদী এখন দখল, দূষণে বিপর্যস্ত। নদীর কোথাও জলের ক্ষীণধারা, কোথাও চর। নদী থেকে বালু উত্তোলন ও অবাধে মাটি কেটে পানি দূষিত করা হচ্ছে। প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ আঁকাবাঁকা এ নদীর দুই পাশের অংশ ধীরে ধীরে দখল করে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনসহ নানা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।
৩. কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অবৈধভাবে দখল-ভরাটের কারণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে কয়েকটি খাল। অনেক খাল এরইমধ্যে শুকিয়ে গেছে। ফলে প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় সেচ সংকটে অনাবাদী থাকে হাজারো হেক্টর জমির ফসল। উপজেলার জিয়ারকান্দি ইউনিয়নের গোপালপুর হিন্দুপাড় সংলগ্ন ব্রিজের নিচের খালটি অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। এক সময় মালামাল নিয়ে ভারী নৌযান চলাচল করলেও দুই পাড় ভরাট হয়ে যাওয়ায় খালটি অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।
৪. কুমিল্লা শহরকে বন্যার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ বদলে দেওয়া হয়। শহরের অংশটুকুকে লোকে পুরাতন গোমতী নামে ডাকে। কাপ্তানবাজার থেকে চানপুর পর্যন্ত এর বিস্তার। দৈর্ঘ্য ছয় কিলোমিটার। এটি এখন আর নদী নেই। এতে কোনো স্রোত বা নৌচলাচল নেই। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নদীর ওপর পাঁচটি আড়াআড়ি বাঁধ দিয়েছে মানুষের চলাচলের জন্য। এসব বাঁধ চকবাজার, গর্জনখোলা, থানারোড, চৌধুরীপাড়া ও কাপ্তানবাজার এলাকায়। বাঁধবন্দী নদীটি সাতটি বড় ডোবার চেহারা নিয়েছে। গভীরতা কোথাও কোথাও ১০০ ফুটের নিচে নেমেছে। দুই তীরের বাসিন্দারা বছরের পর বছর ধরে নদী দখল করে বাড়িঘর তৈরি করেছে। বাঁধগুলোতে গেলে বোঝা যায়, তাঁদের গৃহস্থালি বর্জ্য ফেলার মূল জায়গা এই নদী। তারা বালু-সুরকি-মাটিও ফেলেন। নদী ভরাট করে জমি বাড়ান।