এই বেলা থেকে বাঁধনটাতে দাও মন
সময় যখন রাজনৈতিকভাবে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তখন আশপাশে যা ঘটছে, তা বুঝতে কষ্ট হয়। যারা দল করে, তারা সেই দলের পেছনেই ছোটে পঙ্গপালের মতো। সত্য তখন তাদের কোনো পক্ষের কাছেই বড় নয়। যেকোনো উপায়ে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করাই তখন তাদের ব্রত হয়ে দাঁড়ায়। আর তাই তারা চোখে শুধু সেটুকুই দেখে, যেটুকু তারা দেখতে চায়। বাকি সব তাদের চোখে মিথ্যা।
কাল ২২ শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস। এই আঁধারে রবীন্দ্রনাথের কাছেই ফিরে যাই। দেখি, তিনি তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এ ধরনের সংকট কীভাবে মোকাবিলা করেছেন।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ ও ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রবিরোধিতা প্রবল হয়ে উঠেছিল। তখনো একদল প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক রবীন্দ্রনাথকে অগ্রাহ্য করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে মুসলমানদের খুঁজে বেড়িয়েছেন এবং ধানখেতে বেগুন খুঁজলে যা হয়, তা-ই করেছেন। তাঁরা ঘোষণা করেছেন, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ধানখেতে তাঁরা বেগুন পাননি। দেশভাগ হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাহিত্যের প্রতিনিধি কি না, তা নিয়েও একটা বড় সময় ধরে বিতর্ক চলেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ দানা বেঁধে ওঠার পরই কেবল রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে বাঙালির মনে আসন করে নিয়েছেন। এ-ও অনেকটা রুশ বিপ্লবের পর রুশ সাহিত্যে তলস্তয়ের স্থান আছে কি নেই, তা নিয়ে প্রকাশিত দ্বন্দ্বের মতো। তারপর যখন বিপ্লবের নায়ক লেনিন লিখলেন, তলস্তয় হলেন ‘রুশ বিপ্লবের দর্পণ’, তখনই কেবল এই সাহিত্যিক রুশ মননে প্রবেশাধিকার পেলেন।
এ লেখায় রবীন্দ্রনাথের দূরদৃষ্টির একটা উদাহরণ দেব। ১৯৮৫ সালে প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথের ‘রথের রশি’ পড়েছি, তখন অবাক হয়ে ভেবেছি, মানুষের অন্তর্দৃষ্টি এতটা তীক্ষ্ণ হয় কী করে? রথ চলছে না কেন, তা নিয়েই সৃষ্টি হয়েছিল বিড়ম্বনা। কারও টানেই রথ চলছে না। ধনপতি, ধর্মনেতা, শিল্পপতিরা কতই না চেষ্টা করলেন, কিন্তু রথ আর চলে না। রথের রূপকে দেশ বা বিশ্বকে ভেবে নেওয়া যেতে পারে। নাটকের সংলাপগুলো পড়লে যেন বর্তমানকেই দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে রথযাত্রার রূপকে আমরা আমাদের সময়টাকেই দেখে ফেলি।
কয়েকটি সংলাপ এখানে তুলে ধরা দরকার, নইলে রবীন্দ্রনাথের শক্তি বোঝা যাবে না। নারীরা রথযাত্রা দেখতে এসেছেন, প্রার্থনা করতে এসেছেন। কিন্তু রথ চলছে না। কেন এ অবস্থা, তা বর্ণনা করছেন সন্ন্যাসী। তিনি বলছেন, ‘আজ ধনীর আছে ধন, তার মূল্য গেছে ফাঁক হয়ে/ ভরা ফসলের খেতে বাসা করেছে উপবাস.../ লক্ষ্মীর ভাণ্ড আজ শতছিদ্র/ তাঁর প্রসাদধারা শুষে নিচ্ছে মরুভূমিতে/ ফলছে না কোনো ফল।’
কিছু কি আর অপরিষ্কার থাকে? তারপরও ব্যাখ্যাটা পোক্ত হয় এই কটি কথায়, ‘তোমরা কেবলই করেছ ঋণ/ কিছুই করনি শোধ/ দেউলে করে দিয়েছ যুগের বিত্ত।’
স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের দেশ কি এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছে? কোনোকালে কোনো একজন শাসক কি জনগণের কথা শোনার চেষ্টা করেছেন?
নাটকেই এরপর দেখি, নারীরা অপেক্ষা করছেন পুরুতঠাকুর কখন এসে মন্ত্র পড়বেন। কিন্তু পুরুতঠাকুর তো নড়েন না। তা দেখে সন্ন্যাসী তাঁদের বলেন, এখন মন্ত্রে কোনো কাজ হবে না। সমস্যাটা কী হয়েছে, সেটাও তিনি জানিয়ে দেন, ‘কালের পথ হয়েছে দুর্গম/ কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও গভীর গর্ত।/ করতে হবে সব সমান, তবে ঘুচবে বিপদ।’
উঁচু-নিচু প্রসঙ্গে নারীরা বলেন, ‘চিরদিনই তো উঁচুর মান রেখেছে নিচু মাথা হেঁট করে।/ উঁচু-নিচুর সাঁকোর উপর দিয়েই তো রথ চলে।’ সন্ন্যাসী ব্যাখ্যা করেন, ‘দিনে দিনে গর্তগুলোর হাঁ উঠছে বেড়ে/ হয়েছে বাড়াবাড়ি, সাঁকো আর টিকছে না/ ভেঙে পড়ল বলে।’
এরপর সৈনিকেরা আসে। তারা জানায়, স্বয়ং রাজাও সৈন্যদের সঙ্গে মিলে রথের রশিতে হাত লাগিয়েছিলেন, কিন্তু রথ তো নড়লই না, এমনকি ক্যাঁচকোচ শব্দও করল চাকাটা। এক সৈনিক বলল, চিরকাল রথ টেনেছে নিচু শ্রেণির মানুষ। তারাই রথ টানে, আর সেই রথে চড়ে ধনীরা (রাজা, সৈনিক, ধনপতি, অর্থাৎ উঁচু মানুষেরা)। মধ্যবিত্ত মানুষের দল তখন শূদ্রদের ব্যাপারে তাদের মত প্রকাশ করে, ‘সেই শূদ্ররা শাস্ত্র পড়ছে আজকাল, হাত থেকে কাড়তে গেলে বলে, আমরা কি মানুষ নই?’/ আরেক নাগরিক বলেন, ‘মানুষ নই! বটে! কতই শুনব কালে কালে।/ কোনদিন বলবে ঢুকব দেবালয়ে।/ বলবে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে নাইব এক ঘাটে।/’ সৈনিক তো সেই উঁচুশ্রেণির প্রতিনিধি, সে বলে ওঠে, ‘আজ শূদ্র পড়ে শাস্ত্র/ কাল লাঙল ধরবে ব্রাহ্মণ। সর্বনাশ!’
এরপরই আছে এক শক্তিশালী সত্যের প্রকাশ। এক নাগরিক বলছেন, রাজার কোনো এক পরামর্শক নাকি রাজাকে বলেছে, ‘কলি যুগে না চলে শাস্ত্র, না চলে শস্ত্র। চলে কেবল স্বর্ণচক্র। তিনি ডাক দিয়েছেন শেঠজিকে।’
এখানে এসে আবার আমরা একটু থামতে পারি। শূদ্র বলতে যদি আমরা আমাদের খেটে খাওয়া মানুষের কথা বুঝে থাকি, তাহলে পরিষ্কার হয়ে যায়, রথ, অর্থাৎ উৎপাদনের চাকা এত দিন ঘুরিয়েছেন তাঁরাই। আর তার ফল ভোগ করেছে উচ্চশ্রেণির মানুষ। আজও কি এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়েছে? ব্রাহ্মণ, সেনারা যখন ফেল মারল, তখন ডাক পড়ল ধনপতির। আমাদের এই সমাজে ধনপতিদের এক অংশের কাজই হলো ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট করা, ঋণ নিয়ে ঋণ শোধ না করা। এই ধনপতিদের দম্ভ এতটাই বেড়ে গেছে যে তারা সরলভাবে সৈনিকদের বলতে পারে, তলোয়ার যদিও সৈনিকদের হাতে চলে, কিন্তু সৈনিকের হাতখানাকে চালাচ্ছে ধনপতিরাই। সৈনিকেরা উত্তেজিত হয়ে উঠলে নাগরিকেরা বলে, ‘তোমাদের তলোয়ারগুলোর কোনোটা খায় ওদের নিমক, কোনোটা খায় ওদের ঘুষ।’