এমন ‘বে-নজির’ সম্পত্তি আসে কোথা থেকে!
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানের সম্পদ যেন উপচে পড়ছে। চলতি বছর মার্চে একটি বাংলা দৈনিকে তাঁর ‘চেরাগপ্রাপ্তি’ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। তাতে এ পর্যন্ত বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কক্সবাজার, সাভারসহ ঢাকার আশপাশে ৬২১ বিঘা জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। রাজধানীর গুলশানে পাওয়া গেছে আলিশান চারটি ফ্ল্যাট, যেগুলোর মোট আয়তন ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট, যার বর্তমান বাজারদর ২৩ কোটি টাকার কম নয়। পরিবারটির নামে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের কয়েক কোটি টাকা মূল্যমানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রও খুঁজে পাওয়া গেছে।
বেনামে আরও কত কী রয়েছে, আমরা জানি না। কিন্তু বেনজীর আহমেদ যেন তাঁর নামকে সার্থক করেছেন। বাংলা ভাষায় ‘বে-নজির’ শব্দের অর্থ, নজিরবিহীন। সত্যিই, আগে কোনো আইজিপি বা শীর্ষস্থানীয় কোনো আমলার এত সম্পদের নজির দেখা যায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন বে-নজির সম্পত্তি আসে কোথা থেকে?
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটরের আবেদনের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে ঢাকার আদালত বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের এসব সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব জব্দ ও ‘ফ্রিজ’ করার আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর সম্পদের ফিরিস্তি এখানেই শেষ বলে মনে হচ্ছে না। রোববার এ নিয়ে সর্বশেষ শুনানিকালে দুদক আইনজীবী জানিয়েছেন, বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের খোঁজ চেয়ে বিভিন্ন জেলায় দুদক চিঠি দিয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য আসতে শুরু করেছে। সোমবার সমকাল বলছে, বিদেশেও বেনজীর পরিবারের সম্পদের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।
সংবাদপত্রে আলোচ্য প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বেনজীর আহমেদ এগুলোকে নিছক ‘কুৎসা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “একজন অনেক ক্ষিপ্ত, খুবই উত্তেজিত হয়ে এক্ষুণি সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, প্রবন্ধ লিখে ফেলছেন। দয়া করে সামান্য ধৈর্য ধরুন। ঘোষণাই তো আছে ‘কুৎসার কিসসা আভি ভি বাকি হ্যায়’।” তবে দুদকের অনুসন্ধান দেখে মনে হচ্ছে, বেনজীরের সম্পদের তথ্য যতটুকু পাওয়া গেছে, তা ‘ট্রেইলার’ মাত্র; হিন্দি সিনেমার সংলাপের মতো বলা যায়, ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’।
এমনটা মনে করার কারণ হলো, এ পর্যন্ত দুদকের জালে ওঠা বেনজীর ও তাঁর পরিবারের মালিকানাধীন সম্পত্তির প্রায় সবই এসেছে তিনি পুলিশ ও র্যাবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা থাকাকালে বা চাকরি থেকে অবসরের পরপর। ২০১৫ সালে র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাওয়ার আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার ছিলেন। প্রায় সাড়ে চার বছর র্যাবের শীর্ষ পদে থাকার পর ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল পুলিশের মহাপরিদর্শক হন তিনি। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি অবসরে যান। সত্যিই কি চাকরিজীবনে তিনি আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিলেন?
এদিকে, আদালত দ্বিতীয় দফায় যে ২৭৬ বিঘা জমি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন, তার পুরোটাই বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে। জমিগুলো মাদারীপুরের সাতপাড় ডুমুরিয়া মৌজায়, ২০২১ ও ২০২২ সালের বিভিন্ন সময় ১১৩টি দলিলে কেনা। গুলশানের অভিজাত চার ফ্ল্যাটও কেনা হয় এক দিনে (২০২৩ সালের ৫ মার্চ) বেনজীর অবসরে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে।
উপরন্তু আদালতে জব্দ বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ৬২১ বিঘা জমির মধ্যে ৫২১ বিঘার একক মালিক বেনজীরের স্ত্রী। গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটের তিনটিরই মালিক তাঁর স্ত্রী। অথচ বেনজীর পুলিশে চাকরি করাকালে তাঁর স্ত্রী কোনো পেশায় ছিলেন বলে জানা যায়নি। শুধু দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর বেনজীর এক ভিডিও বার্তায় দাবি করেন, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা মৎস্য খামারি। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, স্ত্রী ও সন্তানদের মালিকানাধীন গোপালগঞ্জের সাভানা এগ্রো প্রজেক্ট শুরু হয় ২০১৪ সালে, যখন তিনি ঢাকার পুলিশ কমিশনার। অভিযোগ আছে, সে প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫ কোটি টাকা। যদিও বেনজীর এ অঙ্কটি সঠিক নয় দাবি করে বলেছেন, প্রকল্পের অর্থায়ন হয়েছে ব্যবসা ছোট থেকে বড় করার প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত মুনাফা ও ব্যাংক ঋণ থেকে।