ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আইনের আওতায় আনা হোক
সম্প্রতি ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় ৮ হাজার ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গত ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ কথা জানিয়েছেন।
এর আগেও বিভিন্ন সময়ে তালিকাভুক্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম বাতিল করা হয়েছে। বাতিলকৃতদের মধ্যে ছিলেন অনেক হোমরাচোমরা। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৯ থেকে ২০২৩– এই পাঁচ বছরে ২ হাজার ১৯০ ব্যক্তির নাম গেজেট থেকে বাতিল করা হয়। ২০১৪ সালে অন্তত পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় আমলার সনদ বাতিল করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে এবারের মতো একসঙ্গে এত বেশি সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি।
কয়েক দশক ধরেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন চলছে। বর্তমান সরকারের আমলেই (২০১৯ থেকে ২০২৩) নতুন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য ১০ হাজার ৮৯১ জনের নাম সুপারিশ করেছিল জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। গেজেটভুক্তির জন্য অনেকের নামে সুপারিশ করেছেন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। সুপারিশকারীদের মধ্যে জামুকার সদস্যরাও রয়েছেন। এরও আগে ২০০৯ থেকে ২০১৪– এই পাঁচ বছরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন। এ যেন এক অন্তহীন প্রক্রিয়া।
যতটুকু জানা যায়, স্বাধীনতার পর অন্তত সাতবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। আর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার। কিন্তু চূড়ান্ত কোনো তালিকা এখন পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে নিরূপণ করা যায়নি মুক্তিযোদ্ধার সঠিক সংখ্যাও।
মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার। অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদের নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে প্রণীত একটি তালিকা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা হয়। তাতে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। এর পর ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও ২০০৩ ও ২০০৪ সালে দুটি পৃথক তালিকা প্রকাশ করে। তাতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা
দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৭। (প্রথম আলো, ২৬ মার্চ, ২০২৩)।
স্বীকার করি, জাতীয় পর্যায়ের একটি তালিকা করতে গেলে কিছু মানবিক ভুল হতেই পারে। তাই বলে ৮ হাজারের বেশি ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ তালিকায় প্রবেশ করেছিল!
বর্তমানে একজন মুক্তিযোদ্ধা মাসে ২০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা পান। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবী হলে দু’বছর বাড়তি চাকরির নিশ্চয়তা। তাদের সন্তান-সন্ততিরা পান চাকরিক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা। ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসা, আবাসন, রেশনসহ নানা রকম সুযোগ-সুবিধা তো আছেই। এ ছাড়া বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোতে বেশ সুবিধা পেয়ে থাকেন।
দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ সম্মান ও সুবিধা পেতেই পারেন। এসব দেখে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধ না করেও তালিকায় স্থান লাভের অপচেষ্টা করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, যারা তালিকা প্রণয়ন, যাচাই-বাছাই, প্রকাশ করেছেন, তারা দক্ষতা ও সতর্কতার পরিচয় দিলেন না কেন?
- ট্যাগ:
- মতামত
- ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা
- আইনগত ব্যবস্থা