সংঘাত নয় নির্বাচন হোক উৎসবমুখর
গণতন্ত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সহনশীলতা। নিজ পছন্দ অনুযায়ী, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যই গণতন্ত্রের আবির্ভাব। যে বা যারা এই প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে জনগণের মতামতকে সানন্দে মেনে নেওয়ার মানসিকতা রাখেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তিনিই নেতা হিসেবে এগিয়ে আসেন। স্বাধীনতাউত্তরকাল থেকেই গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে। তবুও এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুদৃঢ় করতে প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তথা আওয়ামী লীগের প্রতি বাংলার জনগণ যদি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সমর্থন না দিত, তাহলে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ কখনো সর্বসাধারণের যুদ্ধ হিসেবে পরিগণিত হতো না। তাই এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়, নিঃশঙ্ক চিত্তে, উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত সত্তরের সাধারণ নির্বাচন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জনক তথা বিশ্বের অন্যতম জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনা, স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ছন্দপতন ঘটায়। একের পর এক সামরিক শাসকদের ছায়াতলে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক দল। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে ভোটাধিকার হরণ করে শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের হোলি খেলা শুরু হয়। এভাবেই চলে যায় দুই দশক। পেশাজীবীদের অব্যাহত সমর্থন, গণতন্ত্রের প্রতি ছাত্রসমাজের অব্যাহত আন্দোলনের চাপে গড়ে ওঠে সাত দলীয়, পনেরো দলীয় ঐক্যজোট। যুগপৎ আন্দোলনে বিদায় নেয় ভোটাধিকার হরণকারী একনায়ক সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়েই ’৯১, ’৯৬ আর ২০০৮ সালে গণতন্ত্রের পুনঃআবির্ভাব হয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি ছলে, বলে, কৌশলে জনগণকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার অপকৌশলে বারবার হোঁচট খেয়েছে গণতন্ত্র, ভোটাধিকারের উৎসব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সাধারণ মানুষ।
ইতিহাসের দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় থেকে ঈর্ষণীয় উন্নয়ন উপহার দিয়ে শেখ হাসিনা অনন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুকুট পেলেও, জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি উৎসবমুখর নির্বাচন উপহার দেওয়ার চ্যালেঞ্জটি এখনো রয়ে গেছে। দেশি-বিদেশি উদ্বেগ সেই চ্যালেঞ্জটিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, ৭ জানুয়ারি একটি উৎসবমুখর ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়ে একদিকে তিনি জনগণের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠায় যেমন বদ্ধপরিকর, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রমাণ করতে চান বাংলাদেশেও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে বিনা বাধায় পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে জনগণের। শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ, এমন সম্ভাব্য পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত বহন করে।