আমাদের মায়েরা ঘুমাতেন কখন? রাত তিনটার সময় বাড়ি ফিরলেও দরজা খুলতেন মা। শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে দরজা খুলে দিয়ে বলতেন, হাতমুখ ধো। টেবিলে খাবার দিচ্ছি।কোনো দিন তো বলেন নাই, টেবিলে খাবার ঢেকে রাখা আছে, খেয়ে নে।
আমাদের ছোটবেলায় তো রেফ্রিজারেটর ছিল না, মাইক্রোওয়েভ ওভেনের তো প্রশ্নই ছিল না। কাজে মায়েরাই রাত দুইটা-তিনটায় ফেরা ছেলেকে নিজ হাত খাবার গরম করে দিতেন চুলা ধরিয়ে।
জ্বর হলে সন্তানের কপালে জলপট্টি দিতেন, কখনোবা কলাপাতা বা পলিথিন পেপার মাথার নিচে রেখে মাথায় পানি ঢালতেন আমাদের মায়েরা।
সবাইকে খাওয়াতেন, নিজে কী খেতেন, কেউ জানে না; হাতে গোনা মাসের টাকায় ১৪ জনের সংসার চালাতেন। সে সংসারে ফেলনা বলে কিছুই থাকত না; লাউয়ের খোসা ভাজি হতো; বিচি ভাজা ছিল রসনাবিলাস; মুরগির চামড়া বেগুন দিয়ে রাঁধলে হতো অমৃত ব্যঞ্জন।
শাড়ি পুরোনো হলে কাঁথা হতো; পাজামা পুরোনো হলে হতো কোলবালিশের খোল। মায়েদের হাতের তালু ছিল থার্মোমিটার; আঁচল ছিল সর্বরোগহরা। তা দিয়ে হাত মুছতেন মায়েরা, কপালের ঘাম মুছতেন, আর মুছে দিতেন সংসারের সব মালিন্য, দারিদ্র্য, জ্বরব্যাধি, মন-খারাপের ব্যামো।
এরই মধ্যে বছর যেতে না যেতেই তাঁদের হতে হতো পোয়াতি। সন্তান উৎপাদন থেকে শুরু করে সংসারের প্রধানমন্ত্রিত্ব, অর্থমন্ত্রিত্ব, খাদ্যমন্ত্রিত্ব, স্বাস্থ্যমন্ত্রিত্ব, শিক্ষামন্ত্রিত্ব, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়—সবকিছুর ভার তো ছিল আমাদের মায়েদেরই। হাতপাখার ডাঁটাটা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজটা দিব্যি চালিয়ে নিতে পারতেন।
সেই মায়েদের কথা কি আমরা মনে রেখেছি!
স্নেহ নিম্নগামী। আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের জন্য জীবনবাজি রেখে কত-কী করেছেন! আর আমরা তার বিনিময়টুকু দিই আমাদের সন্তানদের! গর্ভবতী মা কত সাবধানে থাকেন, এটা কোরো না, পেটের বাচ্চা কষ্ট পাবে, ওটা খেয়ো না; ওর ক্ষতি হতে পারে। রিকশায় উঠো না, রিকশায় বড় ঝাঁকুনি। আর সংসারে একটা নবজাতক এল, তো সব মনোযোগ, সব আনন্দ, সব হাসিকান্না, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কেন্দ্রভূমি ওই ছোট্ট সত্তাটি।