পরীক্ষাভীতি দূর করার উপায়
এ বছর থেকে জেএসসি তথা অষ্টম শ্রেণির সমাপনী ও সমমানের পরীক্ষা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। জানুয়ারির মাঝামাঝিতে প্রধানমন্ত্রী এ পরীক্ষা বাতিলের সুপারিশে সম্মতি দেন। এর আগে বাতিল করা হয় পিইসি তথা পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা। গত তিন বছর করোনার কারণে এ দুটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হলেও পরীক্ষাগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধের দাবি ছিল অনেক দিনের। অবশেষে সেই দাবি পূরণ হয়েছে। এ পর্যায়ে এসে পরীক্ষাগুলোর পোস্টমর্টেম জরুরি। একই সঙ্গে বন্ধ-পরবর্তী প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ শিক্ষার ওপর এটি কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে, সেটিও আলোচনার দাবিদার।
বলে রাখা দরকার, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাটি ২০০৯ সালে হুট করে শুরু হয়েছিল। কোনো ধরনের গবেষণা, প্রস্তুতি ও পর্যবেক্ষণ ছাড়াই এটি চালু হয়। এর পর চালু হয় অষ্টম শ্রেণি সমাপনী পরীক্ষা-জেএসসি। এ দুটি পরীক্ষা ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরীক্ষা দুটি চালুর দু-এক বছরের মধ্যেই এর নেতিবাচক দিকগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পিইসির কারণে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণ ব্যাপকভাবে শুরু হয়। সচ্ছল পরিবারগুলো এক শিক্ষার্থীর জন্য একাধিক শিক্ষকও নিয়োগ করেছে। অথচ দরিদ্র পরিবারগুলো তা করতে পারেনি। এতে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী এমনকি অভিভাবকদের মধ্যেও। গাইড বই, কোচিং-নির্ভরতা তো আছেই; পাশাপাশি শিক্ষকদের দ্বারা পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে অনৈতিকভাবে শিক্ষার্থীদের 'সহযোগিতার' ঘটনাও ঘটেছে। জিপিএ ৫ তথা ভালো ফলের জন্য প্রাথমিক থেকেই শিক্ষার্থীদের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। সে জন্য এই পরীক্ষা দুটি বাদ দেওয়ার দাবি ওঠে শিক্ষাচিন্তকসহ প্রায় সব মহল থেকেই। চিরস্থায়ীভাবে পরীক্ষা দুটি বন্ধ হওয়া তাই এক ধরনের স্বস্তির কারণ বটে। কিন্তু এ পরীক্ষার পক্ষাবলম্বনকারীও যে নেই, তা নয়। এমনকি অনেক শিক্ষকও মনে করেন, পিইসি-জেএসসি চালু রাখা উচিত। তাঁদের মতে, এসব পরীক্ষা থাকার কারণেই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছে। পরীক্ষাগুলো উঠিয়ে দেওয়ায় তারা আগের মতো গুরুত্ব সহকারে পড়বে না। এ থেকে বোঝা যায়, শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা একমাত্র মাধ্যম না হলেও আমরা শুধু পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে আছি। উন্নত বিশ্বে শিশুদের নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষাই নেই। সেখানে তাহলে কীভাবে তারা শিক্ষার্থীদের মেধা পরিমাপ করছে? মূল বিষয় হলো, দীর্ঘদিনের পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা থেকে আমরা বের হতে পারছি না। বিকল্প পদ্ধতিগুলো যদি শিক্ষকরা যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারেন, তবে পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়াও অপ্রয়োজনীয় হবে না। অবশ্য শিশুদের বাইরে অন্য শ্রেণিতে তো পরীক্ষা থাকছেই। আর বুঝতে হবে, পরীক্ষা থাকা এবং পরীক্ষা-নির্ভরতা এক কথা নয়।