দুর্নীতি রেখে পুঁজি পাচার নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল। ২০১৯ সালে যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ও 'ক্যাসিনো গডফাদার' সম্রাটকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে এই নীতির বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ওই গ্রেপ্তার অভিযানে ভাটার টান লাগে। এখন দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম 'বাত কা বাত'।
২০০১ থেকে ২০০৫ সাল- পরপর পাঁচ বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করেছিল। ওই পাঁচ বছরের প্রথম বছর ক্ষমতাসীন ছিল আওয়ামী লীগ; পরের চার বছর বিএনপি-জামায়াত জোট। এর পর 'ওয়ান ইলেভেন' সরকারের দুই বছরের শাসনামলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দমননীতি বাস্তবায়নের কারণে আমরা ওই 'ন্যক্কারজনক চ্যাম্পিয়নশিপ' থেকে নিস্কৃতি পেয়েছিলাম। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন যেন ফের 'নখদন্তহীন বাঘ'। ২০১৪ সাল থেকে গত আট বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করে চলেছে।
ওদিকে ২০১৪ সালেই পুঁজি পাচারকে বাংলাদেশের জন্য গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি-জিএফআই। তারা বলছে, এ দেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আমদানি বাণিজ্যে ব্যাপক ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যাপক আন্ডার ইনভয়েসিং, হুন্ডি প্রক্রিয়ায় ক্রমবর্ধমান পুঁজি পাচার, রপ্তানি আয়ের বড় অংশ দেশে ফেরত না আনা- এই চারটিকে পুঁজি পাচারের সবচেয়ে চালু পদ্ধতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর পর চাহিদা ও সরবরাহ উভয় দিক থেকে হুন্ডি ব্যবসা অনেকখানি গুটিয়ে গিয়েছিল। যার সুফল হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছিল। এ কারণেই ওই দুই অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত বেড়ে গিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে মহামারির তাণ্ডব কমে আবারও চাঙ্গা হয়ে ওঠে হুন্ডি ব্যবসা। গত ১১ সেপ্টেম্বর সিআইডির বরাতে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে, বছরে কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে; যার অর্ধেকের মতো যাচ্ছে হুন্ডি প্রক্রিয়ার লাগামহীন বিস্তারের মাধ্যমে।