'এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে'
‘হাওয়া’ ছবিতে খাঁচায় একটি পাখি দেখানোকে কেন্দ্র করে নানা ক্ষেত্রে বেশ আলোচনা হচ্ছে। অনেকে পাখিকে খাঁচাবন্দি করার প্রতিবাদ করছেন। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে কেউবা নিজেকে খাঁচায় বন্দি করে রাখছেন। কেউ কেউ ছবি এবং তার পরিচালকের পক্ষে বলছেন। খাঁচাবন্দি পাখি আমিও দেখতে চাই না। এসব নিয়ে লিখতে গিয়ে হঠাৎ 'জীবন থেকে নেয়া' ছবির একটি গান মনে পড়ছিল। অসাধারণ সে ছবিটির দ্যোতনাময় গানটি হলো, 'এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে।' পাকিস্তানি উপনিবেশবিরোধী সে গানটি এখনো কীভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে তা ভেবে আমি রোমাঞ্চিত হই। এ যেন শুধু মানুষের মুক্তি নয়, সমগ্র বিশ্বের সকল প্রাণির মুক্তিরও সঙ্গীত হয়ে উঠেছে। এ ছবিতে খাঁচাবন্দি পাখির দৃশ্যের ঘটনাটি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণির প্রতি অনেকের ভালোবাসা দেখে আমি প্রাণিত হয়েছি। বলতে চাই, শুধু ‘হাওয়া’ ছবির খাঁচা নিয়ে নয়, বিশ্বের দেশে লাখ লাখ বন্যপ্রাণিকে যে চিড়িয়াখানার নামে, সাফারি পার্কের নামে, বড় লোকদের সৌখিনতার নামে খাঁচায় পুরে রাখা হয়েছে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক মানুষ। খাঁচাবন্দি সকল প্রাণি মুক্ত হোক। তারা তাদের স্থানে ফিরে যাক। বন্যেরা বনেই সুন্দর থাক।
বিতর্কের সূচনা যে ‘হাওয়া’ নামের ছবিটি নিয়ে তা আমাদের প্রায় মুখ থুবড়ে পড়া চলচ্চিত্র জগতে মুক্ত, দখিনা ‘হাওয়া’ দান করেছে। অনেকদিনের পড়ে থাকা জঞ্জাল, আবর্জনা উড়িয়ে দিয়ে অচলায়তনটিকে জাগিয়ে দিয়েছে। মানুষকে হলমুখী করেছে। সিনেমামুখী করেছে। মৃতপ্রায় চলচ্চিত্র জগতকে মৃতসঞ্জীবনী দান করেছে।
২৫ অগাস্ট কাঁটাতারের বেড়ার আদলে সেট তৈরি করে সেই মঞ্চে বসে সরব হয়েছেন নির্মাতা ও শিল্পীরা; দাবি তুলেছেন ‘হাওয়া’ সিনেমা এবং পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন বিরুদ্ধে মামলা তোলার। পাশাপাশি পরিচালক মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’কে মুক্ত করার দাবির কথাও বলেছেন তারা। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে।
কেননা, এর আগে আমরা চলচ্চিত্রবিহীন চলচ্চিত্রশিল্পীদের নোংরা রাজনীতি দেখেছি। নির্বাচনের নামে তামাশা দেখেছি। সে তামাশার নির্বাচনের জয়-পরাজয় নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও দেখেছি। শুটিংবিহীন এফডিসি দেখেছি, কিন্তু প্রকৃত সিনেমা বা সুস্থ বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্রের নির্মাণ দেখিনি। এই খরার মধ্যে শান্তির বারিধারার মতো দুটো ছবি মুক্তি পেলো, ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’। ‘পরাণ’ ছবিটি গতানুগতিক বাণিজ্যিক ছবি। কয়েকবছর আগে বাংলাদেশের একটি জেলায় ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনার গল্পের আদলে নির্মিত ছবিটি অ্যাকশনধর্মী হলেও কাহিনি, অভিনয় এবং নির্মাণকুশলতার কারণে দর্শকের মন জয় করতে সক্ষম হয়। মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে গেছে। আমি নিজেও গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখেছি, অন্যকেও দেখতে উৎসাহিত করেছি।
এরপরই মুক্তি পায় ‘হাওয়া’। মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই ছবিটি বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনায় আসে। বিশেষ করে একটি গান 'তুমি বন্ধু সাদা পাখি' ছবি মুক্তির আগেই ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মনপুরার পরে ‘হাওয়া’ দ্বিতীয় ছবি যার গান, কাহিনি তরুণ থেকে বয়স্ক সবশ্রেণির মানুষের কাছে আগ্রহোদ্দীপক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ নিয়ে যারা ভাবেন, বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে যারা ভাবেন, দেশের কোনো ইতিবাচক ঘটনায় যারা প্রবল আশাবাদী হয়ে ওঠেন তাদের কাছে মাত্র দুটো ছবি হিট হয়েছে সেটাও অনেক বড় অর্জন বলে বিবেচিত হয়েছে। তারা আন্তরিকভাবে উদ্দীপ্ত হয়েছেন। এক কথায় বলি আনন্দিত হয়েছেন।
কিন্তু বাংলায় একটি শব্দ আছে 'পরশ্রীকাতরতা'। এটার ইংরেজি কী জানি না। বিজ্ঞজনেরা বলেন, শুধু ইংরেজি নয়, পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় এই শব্দটির প্রতিশব্দ নেই। কেন নেই? পরশ্রীকাতরতার অর্থই তারা জানে না, কারণ তাদের চরিত্রে পরশ্রীকাতরতাই নেই। অন্যের সাফল্য দেখে, উত্থান দেখে এরা ঈর্ষান্বিত হয় না। বরং তারা খোলা মনে প্রশংসা করে। উৎসাহিত করে। 'নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা'র মতো বাগধারার খোঁজও অন্যভাষায় পাওয়া যায়নি। আমাদের দেশে এটা প্রবলভাবে বর্তমান। সমাজে কারো অগ্রগতি অন্যরা সহ্য করে না। একজন উঠতে চাইলে নয়জন তাকে টেনে নিচে নামাবে।
বাঙালির এই চরিত্র নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি স্বর্গ-নরক পরিদর্শনে গেছেন। স্বর্গ দেখার পর তারা নরক পরিদর্শনে গিয়ে দেখলেন নরকবাসী পাপীদের জ্বলন্ত চুলার ওপর বড় বড় কড়াইয়ে সেদ্ধ করা হচ্ছে। একেকটি কড়াইয়ে একেক দেশের পাপীরা আছে। প্রতিটি কড়াইয়ে চারপাশে প্রহরীরা বড় বড় লাঠি হাতে দণ্ডায়মান। কড়াই থেকে কেউ উঠে পালাবার চেষ্টা করলে তাকে লাঠি দিয়ে গুতিয়ে আবার কড়াইতে ফেলা হচ্ছে। পরিদর্শকরা যেতে যেতে দেখছেন আর জিজ্ঞেস করছেন, এটা কোন দেশের? ওটা কোন দেশের? প্রহরীরা তাদের জানাচ্ছেন কোনটা কোন দেশের পাপীদের কড়াই। দেখতে দেখতে একটি কড়াইয়ের সামনে এসে তারা থ বনে গেলেন। দেখলেন সেখানে কোনো প্রহরী নেই। পরিদর্শকরা জানতে চাইলেন এটা কোন দেশের? প্রহরীরা জানালো এটা বাংলাদেশের। পরিদর্শকরা সবাই একবাক্যে বলে উঠলেন, বাহ, চমৎকার! বাঙালিরা এত সভ্য ও ভদ্র। তাদের পাহারা দিতে হয় না। প্রহরীরা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলল, সেটা নয় মোটেই। কারণ হলো এক বাঙালি কড়াই থেকে পালাতে চাইলে শত বাঙালি তাকে টেনে আবার কড়াইতে ফেলে ফলে আমাদের কষ্ট করে পাহারা দিতে হয় না।