আমরা চলছি ঠিকই, কিন্তু এগোচ্ছি কি?
আমার শৈশবের সুখস্মৃতিগুলোর একটি হচ্ছে আড়িয়ল বিলে নৌকাভ্রমণ। বর্ষায় পানি থইথই করত। সেই বয়সে সমুদ্র দেখিনি, কিন্তু আমাদের টইটম্বুর আড়িয়ল বিলকে দেখে মনে হতো সমুদ্র দেখতে পাচ্ছি। শরৎকালে পানি কিছু কমত, সেটাই ছিল বেড়ানোর কাল। নৌকায় চেপে পরিবারের সবাই মিলে রওনা হতাম নানাবাড়িতে, বিলের পথে। তখন নীরব কর্তৃত্ব ছিল আমার মায়ের। পিতা থাকতেন, সর্বদা তিনিই প্রধান; কিন্তু নৌকাভ্রমণের সংক্ষিপ্ত সময়টাতে মা হয়ে উঠতেন কর্তা। খাবারদাবারের আয়োজন, আত্মীয়দের জন্য উপহার সংগ্রহ, সহযাত্রীদের ভালোমন্দের তত্ত্বাবধান—সবকিছু মিলে চলত তাঁর বিশেষ সংসারিত্ব। না, জীবনের ওই দিনগুলোকে আদর্শায়িত করব না। অভাব ছিল, আয়োজন ছিল অকিঞ্চিৎকর। সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার নামত ঝুপ করে, চাঁদনি রাতেও চারপাশের গাছপালায় ভূতের ছায়া কল্পনা করে গা ছমছম করত, কিন্তু প্রাণ ছিল। উগ্র নয়, শান্ত। ওই প্রাণ বিশেষভাবেই সজীব হয়ে উঠত বর্ষা শুরু হলেই। আকাশ থেকে বর্ষণ, মাটিতে পানির ছোটাছুটি। খাল উপচে পানি এসে পড়ত পুকুরে, চলে যেত ধানের খেতে, মিলত গিয়ে বিলের সঙ্গে। ওই সজীবতাটা ভালো লাগত; কিন্তু ভয়ও পেতাম। অন্ধকারকে তো অবশ্যই, ভয় পেতাম এমনকি আড়িয়ল বিলকেও। তার বিশালতার জন্য। রাত হয়ে গেলে বিলের মাঝিরাও ভয় পেত দিক হারিয়ে ফেলবে ভেবে।
ভয় মানুষের নিত্যসঙ্গী। এখন গ্রামে গেলে দেখি অবিশ্বাস্য রকমের উন্নতি ঘটেছে। শহর চলে এসেছে গ্রামের ভেতরে। বাসে ও অটোরিকশায় যাতায়াত, বিদ্যুৎ, সিলিন্ডারের গ্যাস, দোকানে শহরের পণ্য, ঘরে ঘরে শহুরে চ্যানেল—সবকিছুর চমৎকার সমারোহ। ভালো লাগে, কিন্তু ভয়ও পাই। ভয় পাই পানির অভাব দেখে। খাল রূপ নিয়েছে এবড়োখেবড়ো পথের, বাড়ির সামনের পুকুরটা মৃতপ্রায়, অদূরে আড়িয়ল বিল কোনোমতে টিকে আছে (বহুবিধ আক্রমণ সহ্য করে), পানি তো প্রাণ। সজীবতা না থাকলে উন্নতি তো ভীতিকর। পারিবারিকভাবে গ্রামে আমরা ধারাবাহিকভাবে থাকতে পারিনি। তবে মনে পড়ে, তিনবার কাটাতে হয়েছে বেশ কিছু সময়, তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। প্রথমটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয়টি সাতচল্লিশের দেশভাগ, তৃতীয়টি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পিতৃতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওই তিন ঘটনাপ্রবাহে আমরা গ্রামে চলে এসেছি, গ্রাম আমাদের আশ্রয় দিয়েছে মা-খালার মতো।
চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে যখন বিশ্বব্যাপী এক যুদ্ধ চলছিল, তখন কলকাতায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল জাপানি বোমার। ভয় পেয়ে মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামমুখী হয়েছে। আমার পিতাও এসেছিলেন গ্রামে, পরিবার সেখানে রেখে চলে গেছেন তাঁর স্থানান্তরিত কর্মস্থল রাজশাহীতে। তখন আমি শিশু, সেটাই আমার প্রথম গ্রাম দেখা। আড়িয়ল বিল দেখলাম, প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হলাম, সাঁতার কাটা শিখলাম পুকুরে। কিছুদিন পরে রাজশাহীতে চলে যাওয়া। কয়েক বছর পরে আবার ফিরে আসতে হয়েছিল গ্রামের আশ্রয়ে। সাতচল্লিশ সালে, দেশভাগের কারণে। তখন স্বপ্নের মায়াবী ঘোর মানুষের চোখেমুখে। বিষয়টি নিয়ে আমার বাবার সঙ্গে কথা হয়নি, কিন্তু নিশ্চয়ই তিনি আশা করতেন বুড়িগঙ্গার ওপরে দু-তিনটি ব্রিজ হবে, গ্রামের সঙ্গে নতুন রাজধানী ঢাকার যোগাযোগটা হবে সহজ, যেমনটা কলকাতায় ছিল তার আশপাশের এলাকার সঙ্গে।
আমি তখন নানান ঠিকানায় থাকি, গ্রামেও এসেছিলাম একপর্যায়ে। দেখি অনেকেই এসেছেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরে এরা কিছু কিছু উন্নতি করেছেন, এবার ভাবছেন প্রয়োজনে গ্রামেই থাকবেন অনেক দিন। বাড়িঘর গোছাচ্ছেন, জমিজমার খোঁজখবর নিচ্ছেন, পুকুরটাকে নিচ্ছেন সংস্কার করে, ফলদ গাছ কোথায় কয়টা আছে হিসাব কষছেন। বিপদের ছায়ার নিচে নতুন জীবন গড়ার আশা। ওই চিন্তায় আমরা যে যোগ দিইনি, এমন নয়। দিয়েছি। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের পরে দেখা গেল কোথায়, কী, সবাই পড়ি তো মরি করে ছুটেছেন, কার আগে কে গিয়ে পৌঁছাবেন শহরে। তবে একাত্তরের পরের গ্রাম তো আগের মতো নেই। থাকা সম্ভব ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের ছেলেরা কোনো না কোনোভাবে অংশ নিয়েছে। মেয়েরাও জড়িয়ে গেছে মনেপ্রাণে। যুদ্ধ শেষে যুবকেরা গ্রামেই রইল। ভাবল, গ্রামকে উন্নত করবে। কিন্তু গ্রামকে তো আলাদা করে গড়া সম্ভব নয় শহরের সাহায্য ছাড়া। তা ছাড়া, তাদের তো পথও জানা ছিল না। দেশে এখন ছেলেদের সুবিধা হয়েছে, মেয়েদের আরও বেশি; তারা গ্রামে থেকেই গ্র্যাজুয়েশন করতে পারছে। মেয়েদের উৎসাহই অধিক। ছেলেরা তবু ঝরে পড়ে। মেয়েরা টিকে থাকে। ঝড়-বাদলে ছাতা মাথায় কলেজে যায়। খরার সময়েও দমে না। কেউ কেউ সাইকেল পর্যন্ত চালায়। ছেলেদের জন্য সুযোগ এল চাকরি করতে বিদেশে যাওয়ার। সে এক অভাবনীয় ব্যাপার। কত যুবক চলে গেছে বিদেশে! কষ্ট করছে, ভয়াবহ কষ্ট, কিন্তু টাকা পাঠাচ্ছে দেশে। সেই টাকায় বাড়িঘরের চেহারা ফিরেছে, ভাইবোনেরা পড়াশোনা করছে, দোকানপাট হয়েছে, জামা-কাপড় আগের মতো মলিন নয়। উন্নতি দৃশ্যমান। দেখে ভালো লাগে, কিন্তু ভয়ও হয়। ভয় হয় এটা ভেবে, এই উন্নতির ভেতরে প্রাণের প্রাচুর্য নেই। পানির অভাব। পানি তো কেবল জীবনের রক্ষক ও প্রতীক নয়, পানি সামাজিক যোগাযোগ ও পারস্পরিক সহানুভূতির রূপক। পানির প্রবাহ যদি স্বাভাবিক না থাকে, সেখানে যদি দেখা দেয় খরা ও প্লাবন, তাহলে সেটা তো বিপদের ইশারা। মানবিক বিপর্যয়েরও। প্রকৃতি যেমন পানি চায়, মানুষও তেমনি চায় যোগাযোগ ও সহানুভূতি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন