দুর্জনের নেই ছলের অভাব
এখন আমরা স্বাধীনতার মাস অতিক্রম করছি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি একটি ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র। সমজাতীয়তার দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, বিশ্বে খুব কম রাষ্ট্রই আছে যার মধ্যে বিদ্যমান সমজাতীয়তা বেশ ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং ধর্মীয় বিচারেও এর সমজাতীয়তা অতুলনীয়। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। তুলনামূলক বিচারে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ধর্মীয় সহনশীলতা ঈর্ষণীয়। একটি আধুনিক জাতিরাষ্ট্র হওয়ার জন্য বাংলাদেশে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় গর্ব করার মতো। এসব সত্ত্বেও বাংলাদেশের বড় দুর্বলতা হলো ভয়াবহ রাজনৈতিক বিভাজন। রাজনৈতিক বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের দিক থেকে মতপার্থক্য থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এই মতপার্থক্য যদি পারস্পরিক হননে জাতিকে ভ্রান্তি ও সংঘাতের দিকে টেনে নিয়ে যায়, তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। আমরা এই প্রেক্ষাপট নিয়ে এখন আলোচনা করতে চাই না। কারণ, বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং ইতিহাসের উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা এই ক্ষতিকর সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে গেছি।
জাতি গঠন অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। জাতির অন্তর্গত নাগরিকদের ধ্যান-ধারণায় নৈকট্য অর্জনের মাধ্যমে একটি জাতি শক্তি-সাহস অর্জন করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত। এই ৫০ বছরে কমপক্ষে দুটি প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটেছে এবং তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষ এখনও বেঁচে আছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক পর্যায়ে যখন কোনো আলোচনার সূত্রপাত হয় তখন দেখা যায়, দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে পুরাতন ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য বিরাজমান। নতুন প্রজন্মের চিন্তাভাবনায় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে অনেক বেশি উদ্বেগ প্রকাশ পায়। সোজা কথায় বলতে গেলে বলা যায়, নতুন প্রজন্ম ম্যাটারিয়ালিস্টিক। কিন্তু পুরাতন প্রজন্মের চিন্তাভাবনা নৈতিক যথার্থতা-সমৃদ্ধ। যে কোনো দেশ কিংবা সমাজে নতুন প্রজন্মের ভাবধারা থেকে বোঝা যায় আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কেমন হবে। যে কোনো সুস্থ সমাজের জন্য নৈতিকতা এবং সততা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা পরিহার বা বর্জন করে নয়। এক কথায় বলা যায়, আমরা এমন এক বাংলাদেশ চাই, যে দেশ হবে নৈতিকতার বিচারে ঋদ্ধ ও বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা এবং জীবনযাত্রার দিক থেকে উন্নত। এ রকম একটি সমাজ গড়া খুব সহজ কাজ নয়। এ জন্য প্রয়োজন আদর্শস্থানীয় নেতৃত্ব, উন্নত মান ও মহত্ত্বর মূল্যবোধে উজ্জীবিত নাগরিক সমাজ। বাংলাদেশের যে কোনো স্থানে গেলে বোঝা যায়, দেশটি কতটুকু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এই পরিবর্তন যে উদ্যোক্তা সমাজ নিয়ে এসেছে, তারা আগামী দিনে এই পরিবর্তনকে আরও অনেক গভীরে নিয়ে যাবে। আমরা একটি পরিবর্তিত বাংলাদেশ পাব- এ কথা বেশ আস্থার সঙ্গে বলা যায়।
বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নততর হয়েছে; আনন্দের সঙ্গে এটি বলা যায়। কিন্তু বিশেষ বিশেষ দুর্বলতা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অসহিষুষ্ণতা এবং রাজনৈতিক অনাচার বাংলাদেশকে দুষ্টগ্রহের প্রভাব বলয়ে আটকে রাখতে চাইছে- এই অপ্রিয় সত্যটি অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্যপিষ্ট দেশ কোনোক্রমেই সম্পদের অপব্যবহার করতে পারে না। প্রাপ্ত সম্পদকে সুস্থ এবং দক্ষভাবে ব্যবহার করতে না পারলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। অথচ প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি এ দেশে সীমিত সম্পদের অপচয়। সাম্প্রতিক সময়ে আমার বাসস্থানের পাশ দিয়ে যে সড়কটি গেছে, তার ফুটপাত ভেঙেচুরে এতটাই জঞ্জাল-আকীর্ণ করেছে যে, এই পথ দিয়ে হাঁটাই অসম্ভব। ৬-৭ মাস আগেও এমনিভাবে এই ফুটপাতের 'উন্নয়ন' করতে দেখেছি। তখন এই ফুটপাতটি চলাফেরার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল। ৬ মাসের মাথায় এমন কী ঘটল যে, ফুটপাত ও তার নিচের মাটি তুলে ফেলে পথচারীদের কষ্ট দিচ্ছে- এটুকু ভাবার কর্তৃপক্ষীয় কোনো সিরিয়াসনেস দেখা যায় না। নানাজনকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি, এই ফুটপাতের নিচ দিয়ে চলে গেছে বর্জ্য নিস্কাশনের একটি নালা। বলা হচ্ছে, আগেরবার 'উন্নয়ন' করতে গিয়ে এই নালা যতটুকু গভীর করা হয়েছিল, তা যথেষ্ট ছিল না। এখন এই নালাটিকে আরও গভীর করা হচ্ছে। এই ফুটপাত ব্যবহারকারীদের বিড়ম্বনার অবসান কবে হবে, কেউ বলতে পারে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দুর্নীতি
- স্বজনপ্রীতি