
ছবি সংগৃহীত
বাস যখন যৌথ পরিবারে
আপডেট: ২৪ মে ২০১৩, ১৭:১২
একটা সময় ছিল যখন দাদা, দাদি, চাচা- চাচী, ফুফু আর অনেক ভাইবোন নিয়ে সবার একটা বড়সড় পরিবার থাকতো। এক সাথে এক ছাদের নিচে বসবাস করেছেন সবাই। এক সাথে সকল সুখ দুঃখের ভাগীদার হয়েছেন সবাই মিলে। বিপদে মুখ ফুটে বলার আগেই চলে এসেছে সাহায্য। সেই সাথে টুকটাক মনমালিন্যও যে হয়নি তাও কিন্তু না। তারপরেও সংসারের হাল সবাই মিলেমিশেই ধরেছেন। যদিও এখন এই রকম যৌথ পরিবারের দেখা খুব একটা না মেলে না, তবুও আমাদের সমাজ থেকে পুরোপুরি হারিয়েও যায়নি তা। এখনো কোনও কোনও চার দেয়ালের ঘরের মাঝে দেখা মেলে এমন পরিবারের। যৌথ পরিবারে বসবাসের সুবিধাগুলো তারাই ভালো বুঝতে পারবেন, যারা এমন কোন পরিবার থেকে এসেছেন বা জীবনের কোনও এক সময় এমন পরিবারে সময় পার করেছেন। এক সাথে সবাই মিলে পরিবারের হাল ধরার ফলে একজনের উপরে যেমন সমস্ত চাপ পড়ে না, তেমনই বিপদে আপদে বাইরের মানুষের সাহায্য খুব একটা দরকার হয়না। বাসার সদস্যরা মিলেই যে কোনও বিপদে একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে মোকাবেলা করেন দৃঢ়তার সাথে। সেই সাথে শিশুদের জন্যও যৌথ পরিবার অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কেননা একের অধিক শিশু এক সাথে বড় হবার ফলে তাদের মাঝে সহনশীলতা, সামাজিকতা, মিশুক হবার প্রবণতা অধিক দেখা যায় একক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুদের তুলনায়। তবে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের বৈচিত্র্যের মতন যৌথ পরিবারেও আছে নানাম সমস্যা। প্রথম সমস্যা হলো, এমন পরিবারে প্রধান কর্তা হিসেবে থাকেন দাদা-দাদি বা নানা-নানি পর্যায়ের বয়স্ক জনেরা। এবং তাঁদের মাধ্যমেই পরিবারের প্রধান প্রধান সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়ে থাকে। এখানে সব চাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে, বয়সের কারনে হোক বা যুগের পরিবর্তন, সেকেলে মানসিকতা ইত্যাদি অনেক কারনে হোক তাঁদের দ্বারা গৃহীত অনেক সিদ্ধান্তই সমসাময়িক চিন্তাধারা ও জীবনের সাথে খাপ খায়না। ফলে পরিবারে তরুণদের সাথে বিরোধের একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। সেই সাথে অন্যতম প্রধান আরেকটি সমস্যা হলো একান্ত সময় পাওয়াটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় সদস্যদের জন্য। তারপরেও পরিবারের জন্য বা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, অথবা দায়িত্ববোধ থেকেই অনেকে এখনও যৌথ পরিবারকে কায়েম করে রেখেছেন। মিলেমিশে আবেগ আর মমতার বাঁধনে বাঁধা অনেক যৌথ পরিবার এখনও মাথা উঁচু করে টিকে আছে সগর্বে। রাজধানী ঢাকার তুলনায় এমন পরিবারের সংখ্যা দেশের অন্যান্য এলাকাতেই বেশি দেখা যায়। তবে ঢাকা হোক বা অন্য কোন এলাকাই হোক না কেন, যদি যৌথ পরিবারে থাকার সময় কিছু ব্যাপার অবশ্যই মনে রাখে উচিত। তাতে ভুল বোঝাবুঝি বা মনমালিন্য তৈরি হবার সম্ভাবনা কমে যাবে অনেকটাই। আর সম্পর্ক থাকবে অটুট।
যা যা করবেনঃ
- পরিবারটার নাম 'যৌথ' তাই এখানে বড় সিদ্ধান্তগুলো এককভাবে না নেয়াটাই ভাল হবে। যেহেতু এক পরিবারে অনেক সদস্য বাস করছেন ও সবারই নিজস্ব মতামত থাকবে, তাই যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ায় সময় সবার কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ফলে ভবিষ্যতে সেই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে কোনও ধরণের বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।
- যৌথ পরিবারে প্রায়ই আলাদা করে কোন একজন বিশেষ সদস্যকে সময় দেয়া হয়ে উঠেনা। এ সমস্যায় বেশি পড়েন যারা ঘর সামলাচ্ছেন তারা। এমনকি অনেকের ক্ষেত্রে নিজের সন্তানকেও দেয়া হয়ে উঠে না পর্যাপ্ত সময়। এমনটা করবেন না। যে করেই হোক স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানের দিকে পর্যাপ্ত নজর দিন। দরকার পরলে অন্য কারো সাথে সংসারের দায়িত্ব ভাগ করে নিন।
- পরিবারের সকল সদস্য মিলে দিনের যে কোন একটা সময় এক সাথে বসুন ও কথা বলুন। সময়টা হতে পারে সকালের নাস্তার সময় বা রাতের ডিনার। এক সাথে খাবার খেতে খেতে সেরে নিন একে অন্যের সাথে দরকারি-অদরকারি কথাবার্তা। এতে পরস্পরের সাথে সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পাবে।
- পরিবারে নতুন সদস্যের আগমনে তাকে একদম আপন করে নিন। যদি তিনি যৌথ পরিবার থেকে থাকেন, তবে তার সাথে মানিয়ে নেয়াটা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু যদি নতুন বউটি হয় একক পরিবারের, সেক্ষেত্রে হঠাৎ করে যৌথ পরিবারে এসে যেন তার কষ্ট না হয় সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ পরিবারের সদস্যদের কোনও আচরনে যদি বউটি একবার মনে কষ্ট পেয়ে যায়, তবে তার পক্ষে পরবর্তীতে এমন পরিবার ও পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়াটা কষ্টকর হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। ফলে পরবর্তীতে পরিবারের মধ্যে একধরণের রেষারেষির ও কলহের সৃষ্টি হতে পারে।
- যৌথ পরিবারে বাস করতে গিয়ে ভুলে যাবেন না যে আপনি যেমন আপনার বাবা-মা আর ভাইবোন নিয়ে বাস করছেন, তেমনই এই পরিবারের মাঝে আপনার নিজেরও এক���ি সংসার আছে। হয়তো এক ছাদের নিচে থাকছেন সবাই মিলে, কিন্তু আপনার সন্তান বা স্ত্রীর দায়িত্ব কিন্তু আপনার বৈ অন্য কারো নয়। তাই পরিবারের পাশাপাশি নিজের সংসারের দিকেও খেয়াল রাখুন।
- একটানা যৌথ পরিবারে থাকার ফলে একঘেয়েমি চলে আসতে পারে। কারণ এমন পরিবেশে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা অনেকটাই চাপা পড়ে যায়। তাই মাঝে মাঝে একে অন্যকে সময় দিতে পরিবার থেকে ও এই পরিবেশ থেকে বের হয়ে কিছু দিনের জন্য ঘুরে আসুন। একে অন্যকে সময় দিন।
যা যা করবেন নাঃ
- পরিবারের এক সদস্যের সাথে আরেক সদস্যের তুলনা কখনোই করতে যাবেন না। এমন করাটা একটি অসুস্থ মানসিকতা। যে যেমনই হোন না কেন সবাই একই পরিবারের সদস্য। হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান হবেনা, তেমনই ৫ জন মানুষও এক সমান হবেন না। তাই কারো কোন দোষ পেলে সেটা নিয়ে অন্য কারো সাথে তুলনা করার কিছু নেই।
- যেহেতু অনেকগুলো একক পরিবারের সমন্বয়ে একটি যৌথ পরিবার গড়ে ওঠে, তাই একে অন্যের জীবনে অযথা খোঁচাখোঁচির অভ্যাস বন্ধ করতে হবে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে প্রেম-ভালবাসা যেমন থাকবে, তেমনই ঝগড়াও থাকতেই পারে। তাই বলে কোনও সদস্য তাদের নিজস্ব ঘরে ঝগড়া করতে চাইলে অযথা সেখানে গিয়ে তাদের ঝগড়ার মাঝে পরতে যাবেন না। ভুলে যাবেন না যে আপনারা একই পরিবারের সদস্য হলেও জীবনটা সকলেরই পৃথক। আপনাদের কোন অধিকার নেই স্বামী-স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত নিজস্ব জীবনে কোন রকমের হস্তক্ষেপ করা, যতক্ষণ না তাঁরা চাইছেন। তাঁদের সমস্যার সমাধান তাদেরকেই করতে দিন, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাঁরা আপনাদের সাহায্য প্রাথর্না করছেন।
- সন্তানের সামনে ঝগড়া করতে যাবেন না। যেহেতু এটা একটা যৌথ পরিবার, ফলে আপনাদে মধ্যে সমস্যা তৈরি হলে সবাই কিন্তু আপনার সন্তানকেই আগে জিজ্ঞাসা করবে আপনাদের সমস্যার ব্যাপারে। এতে সন্তানের মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। তাই এমন কিছু করতে যাবেন না যাতে আপনার সন্তানের ক্ষতি হয়।
- পরিবারের সব সদস্যের আর্থিক অবস্থা এক পর্যায়ের হবে এমন কোন কথা নেই। এক পরিবারে থেকেও কারো উপার্জন বেশি, কারো বা কম হতে পারে। তাই বলে এটা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগবেন না। অথবা আপনার উপার্জন অন্য কারো থেকে বেশি হলে সেটা নিয়েও বড়াই করতে যাবেন না। আপন মানুষকে ছোট করে কারো কোন লাভ নেই। যেহেতু এক সাথে থাকতেই হবে তাই টাকা পয়সা দিয়ে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে কারো কোন লাভ হবেনা।
- একে অন্যকে হিংসা করতে যাবেন না। একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায়ও যাবেন না। কারো ঘরে টিভি থাকলেই আপনার ঘরেও থাকতে হবে, বা কেউ বড় গাড়ির মালিক হয়ে গেলে আপনার ঘরে ঝগড়া শুরু হয়ে যাবে গাড়ির জন্য- এমনটা যেন না হয়। মনে রাখবেন তারাও আপনাদের জীবনের একটা অংশ। তাই তাদের হিংসা করে নয় বরং তাদের উন্নতিতে খুশি হতে শিখুন।
- যৌথ পরিবারে একজন কর্ণধার খুব বেশি প্রয়োজন। এমন পরিবারের ক্ষেত্রে সংসারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে থাকেন সংসারের কর্ণধার হিসেবে। মনে রাখবেন বয়সের কারনেই কিন্তু তারা পরিবারের কর্তা বলে চিহ্নিত হয়েছেন। তবে মানে আবার এও না যে তাঁরা যে সিদ্ধান্ত নিবেন তার সবটাই সঠিক হবে। কেননা তাঁরাও মানুষ, ভুল তাঁদেরও হতে পারে। তবে এটা নিয়ে ঝগড়া করার কিছু নেই। তাঁদেরকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলুন ও নিজের মতামতটা পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরুন।