ছবি সংগৃহীত

আজ বরেণ্য শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক ডক্টর নীলিমা ইব্রাহিমের মৃত্যুবার্ষিকী

প্রিয় লাইফ
লেখক
প্রকাশিত: ১৮ জুন ২০১৩, ১১:০৪
আপডেট: ১৮ জুন ২০১৩, ১১:০৪

তিনি নীলিমা ইব্রাহীম। অনেকেই তাঁকে চেনেন ড. নীলিমা ইব্রাহীম নামে। তবে শোনা যায়, তিনি নাকি নিজের নামের সাথে ‘ডক্টর’ কথাটা যোগ করতে চাইতেন না। তাঁর অনেক শিক্ষার্থীর লেখায় জানা যায় বিষয়টা কথাটা। তিনি নীলিমা ইব্রাহীম নামেই পরিচিত ছিলেন সবার মাঝে- একেবারে আকাশের নীলিমার মতোই। আজ তার ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী। ১৯২১ সালের ১১ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামের এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা প্রফুল্লকুমার রায় চৌধুরী এবং মাতা কুসুমকুমারী দেবী। মা কুসুম কুমারী সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। মহিলা সমিতির কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন এবং এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের আয় বৃদ্ধি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। বাবা প্রফুল্ল কুমার রায় বাহাদুর উকিল ছিলেন।

নীলিমা ইব্রাহিম বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি খুলনা করোনেশন বালিকা বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা (১৯৩৫), কলকাতা ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশন থেকে আইএ (১৯৩৭) এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএবিটি (১৯৩৯) পাস করেন। (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে তিনি বাংলা বিষয়ে এমএ (১৯৪৩) পাস করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম ‘বিহারীলাল মিত্র গবেষণা’ বৃত্তি লাভ করেন। একই বছর তিনি ইন্ডিয়ান আর্মি মেডিক্যাল কোরের ক্যাপ্টেন ডাক্তার মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। দীর্ঘকাল পরে ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক।’ একই বছর তিনি ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেস থেকে ইন্টারমিডিয়েট ইন ফ্রেঞ্চে ডিপ্লোমা লাভ করেন।
কর্মজীবনের শুরুতে নীলিমা ইব্রাহিম কলকাতার লরেটো হাউসে লেকচারার (১৯৪৩-৪৪) হিসেবে চাকরি করেন। তারপর দু’বছর (১৯৪৪-৪৫) তিনি ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনের লেকচারার ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৭২ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান (১৯৭১-৭৫), বাংলা একাডেমীর অবৈতনিক মহাপরিচালক (১৯৭৪-৭৫) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ (১৯৭১-৭৭)-এর দায়িত্বও পালন করেন। নীলিমা ইব্রাহিম বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজকল্যাণ ও নারী উন্নয়ন সংস্থা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, বাংলাদেশ রেড ক্রস সমিতি ও বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী এবং কনসার্নড উইমেন ফর ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের বোর্ড অফ গভর্নরসের চেয়ারপারসন হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ উইমেনের সভানেত্রী এবং অ্যাসোসিয়েটেড কান্ট্রি উইমেন অফ দি ওয়ার্লাল্ড-এর সাউথ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার এরিয়া প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বার্লিন, মিউনিখ ও ফ্রাংফুর্টে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব সমবায় সম্মেলন’-এ পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৭৩-এ নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক ওয়ান এশীয় সম্মেলন’-এ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৪-এ তিনি মস্কোয় অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বশান্তি কংগ্রেস’, হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বনারী বর্ষ’ এবং ১৯৭৫-এ মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বনারী সম্মেলন’-এ যোগ দেন।
দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনাদের জন্য পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। নীলিমা ইব্রাহীম সে-ই বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাসন্তী গুহঠাকুরতা, নূরজাহান মুরশিদ, রাজিয়া বেগম, মমতাজ বেগম, নওসবা শরীফ। অনেক বীরাঙ্গনাকে ধানমণ্ডিতে পুনর্বাসিত করা হয়। সেখানে তাঁদের মেডিক্যাল সাহায্য দেয়া হতো। সেই কেন্দ্র থেকে প্রায় দুইশত শিশুকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করেছে। যেখানেই যেতেন বুঝতে পারতেন- তিনি নজরদারিতে রয়েছেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জাপানের এক মন্ত্রীর সাথে পূর্ব বন্ধুত্বের সূত্রে ছোট্ট উপহারকে কেন্দ্র করে এনএসআই-এর রোষানলে পড়েন। অবসর গ্রগণের বৈধ সময়ের আগেই তাঁকে বাধ্যতামূলক এলপিআর দেয়া হয়। জীবনের একবারে শেষ প্রান্তে এসে জাতীয় দৈনিকে উপ-সম্পাদকীয় লিখে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালে আজকের কাগজে ‘মাগো আমি কোইত যাবো’ শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় লিখে তৎকালীন সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা রুজু করা হয়। অসুস্থ শরীরে কন্যার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে পুলিশের গ্রেপ্তারের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। পালিয়ে থাকা অবস্থায় হাইকোর্টে সশরীরে উপস্থিত হয়ে তিনি জামিনের আবেদন করেন। মামলাটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ভাষা সৈনিক এডভোকেট গাজিউল হক। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি নিম্ন আদালতে হাজির হলে নিম্ন আদালতের হাজার হাজার আইনজীবী আদালত কক্ষে জমায়েত হন এবং তাঁকে জামিন দেয়া না হলে তাঁরা আদালত কক্ষ ত্যাগ করবেন না বলে জানান। শেষ পর্যন্ত নিম্ন আদালত তাঁকে জামিন দিতে বাধ্য হয়।
নীলিমা ইব্রাহিম বেশকিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার গ্রন্থবদ্ধ রচনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : গবেষণা শরৎ-প্রতিভা (১৯৬০), বাংলার কবি মধুসূদন (১৯৬১), ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজ ও বাংলা নাটক (১৯৬৪), বাংলা নাটক : উৎস ও ধারা (১৯৭২), বেগম রোকেয়া (১৯৭৪), বাঙ্গালীমানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৮৭), সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ (১৯৯১); ছোটগল্প রমনা পার্কে (১৯৬৪); উপন্যাস বিশ শতকের মেয়ে (১৯৫৮), এক পথ দুই বাঁক (১৯৫৮), কেয়াবন সঞ্চারিণী (১৯৬২), বহ্নিবলয় (১৯৮৫); নাটক দুয়ে দুয়ে চার (১৯৬৪), যে অরণ্যে আলো নেই (১৯৭৪), রোদ জ্বলা বিকেল (১৯৭৪), সূর্যাস্তের পর (১৯৭৪); কথানাট্য আমি বীরাঙ্গনা বলছি (২য় খ- ১৯৯৬-৯৭); অনুবাদ এলিনর রুজভেল্ট (১৯৫৫), কথাশিল্পী জেমস ফেনিমোর কুপার (১৯৬৮), বস্টনের পথে (১৯৬৯); ভ্রমণকাহিনী শাহী এলাকার পথে পথে (১৯৬৩); আত্মজীবনী বিন্দু-বিসর্গ (১৯৯১) ইত্যাদি।
নীলিমা ইব্রাহিম আমৃত্যু মানুষের শুভ ও কল্যাণী চেতনায় আস্থাশীল ছিলেন। মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও উদার মানবিকতাবোধই ছিল তার জীবনদর্শন। তিনি সর্বংসহা ধরিত্রীকে স্বর্গের চেয়েও সুন্দর ও কাক্সিক্ষত মনে করতেন এবং অধিকতর আস্থাশীল ছিলেন দেবত্বের চেয়ে মানবত্বে। নীলিমা ইব্রাহিম সমাজকর্ম ও সাহিত্যে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য বহু পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। সেগুলো হলো : বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৭), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৯), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্মৃতিপদক (১৯৯০), অনন্য সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার (১৯৯৭), শেরেবাংলা পুরস্কার (১৯৯৭), থিয়েটার সম্মাননা পদক (১৯৯৮) ও একুশে পদক (২০০০)। ২০০২ সালের ১৮ জুন তার মৃত্যু হয়। তথ্য- বকলম ডট কম ও পদ্মা নদীর মাঝি ব্লগ ছবি- গুণীজন প্রথম ছবি- জীবন সায়াহ্নে নীলিমা ইব্রাহিম দ্বিতীয় ছবি- স্বামী ডা. মোঃ ইব্রাহিম ও নীলিমা ইব্রাহিম তৃতীয় ছবি- বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন ড. নীলিমা ইব্রাহিম চতুর্থ ছবি- শামসুর রাহমানের কাছ থেকে ১৪০৩ সালের 'অনন্যা' পুরস্কার গ্রহণ করছেন পঞ্চম ছবি- বেগম পত্রিকার ২৩তম বার্ষিক অনুষ্ঠানে বামদিক থেকে ড. নীলিমা ইব্রাহিম, বেগম নুরুন্নেসা বিদ্যাবিনোদিনী ও সুফিয়া কামাল