মানবাধিকার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকার কেন প্রশ্নবিদ্ধ
শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে দুর্নীতি, লুটপাট ও দখলদারির পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ছিল একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া—এগুলো ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা। বিরোধী দল ও মত দমনের জন্য ‘গায়েবি’ মামলায় গ্রেপ্তার এবং সাজা দেওয়ারও অনেক ঘটনা ঘটেছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে এবং পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের অবসান এবং অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হবে—অনেকেই এমনটা প্রত্যাশা করেছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় দেড় বছরের শাসনামলে সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছে—এখন এ প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে।
২.
শেখ হাসিনার আমলে সংঘটিত একটি জঘন্য অপরাধ ছিল গুম। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গুমের সেই আতঙ্ক নেই। গুমবিরোধী একটি আইনও করা হয়েছে—এ জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করি, গুমের মতো অপরাধ বাংলাদেশে আর ফেরত আসবে না।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক রাত-বিরেতে সাদাপোশাকে গ্রেপ্তার এবং যথাসময়ে (২৪ ঘণ্টার মধ্য) আদালতে হাজির না করার ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এ বছরের এপ্রিলে মডেল মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তার এবং আটক রাখার ঘটনাটি এ রকম একটি উদাহরণ। মেঘনা আলমকে যেভাবে আটক করা হয়েছিল, সেটা যে আইনসংগত হয়নি, তা স্বীকার করেছিলেন খোদ আইন উপদেষ্টা। (‘মেঘনা আলম যে প্রক্রিয়ায় আটক, তা সঠিক হয়নি: আসিফ নজরুল’, প্রথম আলো, ১৩ এপ্রিল ২০২৫)
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় শুরু হলেও হাসিনার আমলে আরেকটি বড় বিষয় ছিল ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘এনকাউন্টার’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘এনকাউন্টার’ নামে না হলেও অন্যভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সরকারের সময়ে সারা দেশে অন্তত ৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের হিসাবে এ সংখ্যা ৬০। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে গড়ে প্রতি মাসে চারটির বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। (‘গুলি ও নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগে কী বলছে সরকার ও আইএসপিআর, বিবিসি বাংলা, ৮ নভেম্বর ২০২৫)
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটনের দৃষ্টিতে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও তদন্তের ক্ষেত্রে অতীতের ধারাবাহিকতাই বজায় রয়েছে। প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার এবং অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা বাহিনীর আচরণে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। (‘অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হলো না?, বিবিসি বাংলা, ৩১ অক্টোবর ২০২৫)
৩.
মব বা গণপিটুনির ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মব-সন্ত্রাস বা সহিংসতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং নতুন মাত্রা পেয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গত ১০ মাসে মব-সহিংসতা ও গণপিটুনির অন্তত ২৫৬টি ঘটনায় ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ২৩১ জন। এ পরিসংখ্যান আগের দুই বছরকে ছাড়িয়ে গেছে। (‘মব-সন্ত্রাসে ১০ মাসে নিহত ১৪০’, কালের কণ্ঠ, ২৭ নভেম্বর ২০২৫)
মব-সহিংসতায় শুধু মানুষই হতাহত হয়নি, একই সঙ্গে বাড়িঘর, মাজার, দরগাহ ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা এবং মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠী মব-সহিংসতাকে তাদের উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মব-সহিংসতা নিয়ে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিরোজ আহমদ বলেন, ‘...বাংলাদেশে কোনো মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক শক্তি এখন ক্ষমতায় নেই। অথচ সরকার মব-সহিংসতা বা দঙ্গলবাজি বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। এ থেকে বোঝা যায়, সরকারের মধ্যে খুবই প্রভাবশালী একটা অংশ আছে, যাদের কেউ কেউ এই দঙ্গলবাজদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করে।...’ (‘দঙ্গলবাজি করে কেউ কেউ শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করছে’, প্রথম আলো, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫)
৪.
শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য ‘গায়েবি’ মামলা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী আমলে ‘গায়েবি’ মামলা না হলেও ঢালাওভাবে হত্যা এবং হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। লক্ষণীয় হলো, এ রকম হত্যা এবং হত্যাচেষ্টার বেশির ভাগ মামলায় এজাহারের ধরন প্রায় একই রকম এবং একেকটি মামলায় আসামির সংখ্যা কয়েক শ। বিগত সরকার এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের পাশাপাশি আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, খেলোয়াড় বা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ আরও অনেককেই এসব মামলায় আসামি করা হয়। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব মামলার পেছনে হীন উদ্দেশ্য ছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। (‘জুলাই আন্দোলনের মামলা: ঢালাও আসামির নেপথ্যে বাণিজ্য, বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব’, প্রথম আলো, ২৭ এপ্রিল ২০২৫)
ঢালাও মামলা নিয়ে সরকারের বিব্রত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন আইন উপদেষ্টা (‘দেশে ঢালাও মামলার প্রবণতা বিব্রতকর: আইন উপদেষ্টা’, ডেইলি স্টার বাংলা, ১২ নভেম্বর ২০২৪)। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর ফলে অপরাধের সঙ্গে জড়িত না থেকেও বহু মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মানবাধিকার লঙ্ঘন