
কেন জরুরি প্রশ্ন করার অধিকার?
মহাভারতের চরিত্রগুলোর মধ্যে সর্বদাই একটি বিতর্ক বিদ্যমান—কে সর্বশ্রেষ্ঠ? কেউ খুঁজে পান অর্জুনের অতুলনীয় বীরত্বে, কেউ কর্ণের করুণা ও আত্মত্যাগে, আবার কেউ যুধিষ্ঠিরের ধর্মনিরপেক্ষতায়। তবে বহু জ্ঞানী-গুণী পণ্ডিত একমত হন একটি অপ্রত্যাশিত নামে: বিদুর। কেন বিদুর? কারণ তার শক্তি এসেছিল তলোয়ার বা গদা থেকে নয়, বরং তার নৈতিক সাহস থেকে। তিনি ছিলেন সেই বিরল মানুষ, যিনি ‘ঠিককে ঠিক, আর ভুলকে ভুল বলার’ জন্য ভয় পাননি; যিনি সঠিক স্থানে, সঠিক সময়ে প্রশ্ন করতে দ্বিধা করেননি। বিদুর প্রমাণ করেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের চেয়ে রাজসভায় নৈতিকতার প্রশ্ন তোলা আরও কঠিন, আরও জরুরি।
এই বিদুরায়নই আজকের সমাজে সবচেয়ে অপ্রচলিত দক্ষতা। আমাদের মনে প্রতিনিয়ত অসংখ্য প্রশ্ন জন্ম নেয়—অর্থনীতি, রাজনীতি, শাসনব্যবস্থা নিয়ে। কিন্তু সেই প্রশ্নগুলো প্রকাশের আগেই গলা টিপে মারা হয়। কেন? ভয়ে। ভয়ের সেই সংস্কৃতি এতটাই বিস্তৃত যে তা ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত গ্রাস করেছে। প্রশ্ন করলে সাংসারিক শান্তি ভঙ্গ হতে পারে, কর্মক্ষেত্রে বসের কোপে চাকরি যেতে পারে কিংবা সরকার বা ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ে নিরাপত্তা ও শান্তি নামক মরীচিকাটি এক লহমায় বিলীন হয়ে যেতে পারে। প্রশাসনিক ভ্রু কুঁচকে দেখলে কিংবা পুলিশি নজরদারি বাড়লে, একটা নীরব বার্তা দেওয়া হয়—প্রশ্ন নয়, নীরবতা শ্রেয়। এই ভয় কিছু হারানোর; তা জীবিকা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা আত্মমর্যাদা যাই হোক না কেন।
প্রশ্ন না করার এই অভ্যাস সবচেয়ে বেশি প্রকট হয় অর্থনীতির মতো সংবেদনশীল খাতে। দেশের লাখ লাখ বেকার যুবক প্রতি বছর চাকরির জন্য হাহাকার করে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর চাকরির বাজারে আসা ১৫ লাখেররও বেশি যুবকের জন্য সরকারি বা বেসরকারি খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সংখ্যা হতাশাজনকভাবে কম। কিন্তু আমরা প্রশ্ন করছি না: কেন বছরে অন্তত ১০ লাখ বেকারের চাকরি হলো না? কেন চাকরির সঠিক পরিসংখ্যান নেই?
সরকারের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে কিছু সংখ্যা জানানো হলেও, সেই তথ্য যাচাই করার বা সে সম্পর্কে আরও গভীর প্রশ্ন করার সাহস দেখানোর স্পর্ধা আমরা দেখাচ্ছি না। বেকারত্ব শুধু একটি ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় সংকট, যার মূলোৎপাটন প্রশ্নের মাধ্যমেই সম্ভব।
একইভাবে, মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুললেও আমাদের প্রশ্ন ভোঁতা হয়ে যায়। সরকারি উদ্যোগ ও ঘোষণা সত্ত্বেও চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কেন কমছে না? এর সপক্ষে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি বা ডলার সংকটের মতো যুক্তি দেখানো হয়, তখন আমরা প্রশ্ন করি না: আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কমে, তখন কি সেই সুফল দেশে আসে? ডলার সংকটের আসল কারণ কী? এর পেছনে আর্থিক অব্যবস্থাপনা কতটা দায়ী?
এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট, যুক্তিসঙ্গত উত্তর প্রায়শই অধরা থেকে যায়। যখন দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য চালু টিসিবি’র পণ্য বিক্রি চাহিদা থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, তখন আমরা সরকারের কাছে জবাব চাই না কেন এই অপরিহার্য পরিষেবাটি বন্ধ হলো? দারিদ্র্যসীমা ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশে উন্নীত হওয়ার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও যদি আমরা প্রশ্ন না করি, তবে আমরা কোন ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি?
- ট্যাগ:
- মতামত
- মূল্যস্ফীতি
- বাংলাদেশের অর্থনীতি