
অ্যাপার্টমেন্ট কালচার কি শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে
গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের হাত ধরে অনেকের সঙ্গে ভাগ্য খুলেছে আমাদের এক জুনিয়র বন্ধু আবুল হাসেমের (ছদ্মনাম)। অনেক ‘বঞ্চনার শিকার’ হয়ে সে আটকে ছিল উপসচিবের ‘হাফ টেবিলে’। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তরতর করে তাঁর একাধিক পাওনা পদোন্নতি মিলে গেছে। সবাই খুশি। কিন্তু তাঁর ছয় বছরের নাতির মন খারাপ।
নানার পদোন্নতির সুবাদে তাদের বড় ফ্ল্যাটে, বিশেষ করে ঢাউস ড্রয়িংরুমে সে সবকিছু আবছা দেখে। তার কথায় প্রথমে কেউ কান দেয়নি। মনে করেছিল, শুধু শুধু ‘প্যানপ্যান’ করছে। মা–বাবা কাছে না থাকলে (মা-বাবা দুজনই কোরিয়ায় পড়ালেখা করছে) শিশুরা সেই ক্ষোভ নানাভাবে প্রকাশ করে।
তা ছাড়া সে বাসা বদলে রাজি ছিল না। ওখানকার বন্ধুদের সঙ্গে সে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। শিক্ষিত নানা-নানি এসব কার্যকারণ মিলিয়ে শিশুটির অভিযোগ নিতান্তই বাহানা মনে করেছিলেন।
চোখ নিয়ে ‘সমস্যা’য় পড়া পাখির ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি গেয়েছিলেন:
চোখ গেল, চোখ গেল কেন ডাকিস রে
চোখ গেল পাখি (রে)।
পাখি বলতে পারে তার ‘চোখ হারানো’র কথা। কিন্তু আমাদের শিশুরা তা পারে কি?
পদোন্নতির খুশিতে মশগুল নানার এই অসহায় নাতিটি আসলে মায়োপিয়ায় ভুগছে। শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার হার হু হু করে বাড়ছে।
গবেষকেরা এখন আশঙ্কা করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হবে।
২০২৪ সালের ১৮ জানুয়ারি শিশুদের চশমার চর্চা বেড়ে যাওয়া নিয়ে যখন প্রথম আলোয় লিখেছিলাম (চশমা পরা শিশুর সংখ্যা কেন দিন দিন বাড়ছে; প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৪ ), তখন ঠাওর করতে পারিনি, সমস্যাটা যে এত তাড়াতাড়ি সংকটে পরিণত হবে।
মায়োপিয়া কী
মায়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টি হলো একধরনের রিফ্র্যাকটিভ ত্রুটি, যেখানে কাছের জিনিস দেখতে অসুবিধা না হলেও দূরের জিনিস আবছা আবছা লাগে। এটা সাধারণত স্কুলজীবনে শুরু হয় এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগপর্যন্ত বাড়তে থাকে।
মাঝারি বা উচ্চ স্তরের মায়োপিয়া থাকলে পরবর্তী সময়ে গ্লুকোমা, ক্যাটারাক্ট(ছানি পড়া), ম্যাকুলার ক্ষতি (ডিজেনারেশন) ও রেটিনা সরে যাওয়ার (ডিটাচমেন্ট) ঝুঁকি বেড়ে যায়।
চোখের ভেতরের পেছনের অংশে রেটিনার কেন্দ্রে একটি ছোট্ট জায়গা থাকে, সেটাই ম্যাকুলা। এটি আমাদের পরিষ্কার ও সূক্ষ্মভাবে দেখতে সাহায্য করে, যেমন পড়া, লেখা, মুখ চিনতে পারা বা কোনো জিনিসের খুঁটিনাটি দেখা।
ম্যাকুলা ক্ষতিগ্রস্ত হলে দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যায়। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় দৃষ্টি (সেন্ট্রাল ভিশন) নষ্ট হয়, কিন্তু পাশের দৃষ্টি (সাইড ভিশন) সাধারণত ঠিক থাকে।
মায়োপিয়া কি নিরাময়যোগ্য
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মায়োপিয়া সারানো যায় না এবং শিশুরা এটি ওভারকাম (অতিক্রম) বা পরাস্ত করতে পারে না। তবে সঠিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে এর বাড়বাড়ন্তের লাগাম কিছুটা টেনে রাখা যায়। অর্থাৎ দূর হবে না, তবে বাড়ার গতিটা শ্লথ হবে।
সম্প্রতি পৃথিবীর তিন দেশে পরিচালিত তিনটি গবেষণায় প্রায় একই ফল মিলেছে।
চীনের তিয়ানজিন অঞ্চলের প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা করা হয়। ২০২১ সালের ১ মার্চ থেকে ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দুই বছরের মধ্যে ৩ দফা চোখের পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পুরো দুই বছরের ফলোআপ সম্পন্ন করেছে।
আরেকটি গবেষণা চলে দক্ষিণ ভারতে। সেখানে ১৪ হাজার শিক্ষার্থীর ওপর করা গবেষণায় দেখা গেছে, শহরে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। চীনের শিশুদের ওপর করা গবেষণাটিতেও একই ফল পাওয়া গেছে।
অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা গবেষণাতেও শহরে বা শহরের মতো পরিবেশে বসবাসকারীদের মধ্যে মায়োপিয়ার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দৃষ্টিশক্তি
- মায়োপিয়া