
বড়াল নদের দৃষ্টান্ত আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছে
নদী রক্ষার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, পৃথিবীর আর কোনো দেশের জন্য সম্ভবত ততটা নয়। এ রকম পরিপ্রেক্ষিতে এটা দুঃখজনক যে বাংলাদেশে নদ-নদী বিষয়ে যেন এক বৈপরীত্যমূলক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে দেশে শত শত পানি উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, অন্যদিকে নদ-নদীর পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটেছে।
বিগত দশকগুলোতে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নদ-নদী হারিয়ে গেছে। এখনো যেগুলো অবশিষ্ট আছে, তার মধ্যেও বহু নদ-নদী দূষণে-দখলে জর্জর, অগভীর, প্রায় জলশূন্য এবং মৃতপ্রায়।
২.
এই বৈপরীত্যের কারণ কী? কেন শত শত পানি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পরও বাংলাদেশের নদ-নদী আরও সুস্থ ও সবল হওয়ার পরিবর্তে মৃত বা মৃতপ্রায় হয়ে গেল?
এ প্রশ্নের উত্তর একটাই এবং তা হলো বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন প্রয়াস সঠিক পথে অগ্রসর হয়নি। বস্তুত সম্পূর্ণ বিপরীত ও ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হয়েছে।
এটা সুবিদিত যে বাংলাদেশের নদীপ্রবাহের চরম ঋতুভেদ রয়েছে। এর কারণ বৃষ্টির ঋতুভেদ। বার্ষিক মোট বৃষ্টির প্রায় ৮০ শতাংশ মাত্র ৪ মাসে সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে বর্ষার এই মাসগুলোতে নদ-নদী ফুলেফেঁপে ওঠে; কূল ছাপিয়ে প্লাবন ভূমিতে বিস্তৃত হয়, অর্থাৎ প্লাবন ঘটে। কোনো কোনো বছর এই প্লাবন অতিরিক্ত মাত্রায় পৌঁছায় এবং আমরা তাকে বন্যা বলি।
বাংলাদেশের নদ-নদীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, যে পরিমাণ পলিবালু তাদের প্রবাহে থাকে, তা বিশ্বের আর খুব কম দেশেই দেখা যায়। এই পলিবালুর বড় অংশটি ভাসমান অবস্থায় থাকে।
বর্ষাকালে যখন নদীর পানি কূল ছাপিয়ে প্লাবন ভূমিতে বিস্তৃত হয়, তখন পলিবালু ও প্লাবন ভূমিতে বিস্তৃত ও পতিত হয়। ফলে স্বাভাবিক প্লাবন দ্বারা বাংলাদেশ দুইভাবে উপকৃত হয়।
একদিকে এর ফলে প্লাবন ভূমি নবায়িত হয়, পলিপতনে এর উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, জমির উর্বরতা বজায় থাকে, সব জলাধারের নবায়ন ঘটে, তাতে পানি সঞ্চিত হয় এবং তা শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহ বৃদ্ধি করে।
অন্যদিকে প্লাবন ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ার ফলে নদী খাতে কম পলিপতন ঘটে, নদীর গভীরতা বজায় থাকে এবং নদী সুস্থ থাকে।
সুতরাং বাংলাদেশে নদ-নদীর প্রতি সবচেয়ে উপযোগী নীতি হলো প্লাবন ভূমিকে নদ-নদীর প্লাবনের জন্য উন্মুক্ত রাখা, অর্থাৎ ‘উন্মুক্ত পন্থা’র অনুসরণ।
৩.
বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন প্রথম থেকেই পশ্চিমের সংস্থাগুলোর অভিভাবকত্বে অগ্রসর হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় নয় যে তারা বাংলাদেশের পানি উন্নয়নের পরিকল্পনা করে দেওয়ার জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের ডেকে এনেছে। এই বিশেষজ্ঞরা স্বাভাবিকভাবেই নিজ দেশের অভিজ্ঞতা দিয়ে বেশি পরিচালিত হয়েছেন।
পশ্চিমের বেশির ভাগ দেশে বৃষ্টি ও নদীপ্রবাহে ঋতুভেদ স্বল্প এবং পলিবালুর পরিমাণও সামান্য। ফলে এসব দেশে নদ-নদী সারা বছর স্বীয় খাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
সে জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কাছে বাংলাদেশের নদ-নদীসৃষ্ট প্লাবন আশীর্বাদের পরিবর্তে নিছক সমস্যা বলে মনে হয় এবং তাঁরা এই প্লাবন রোধ করাকেই বাংলাদেশের পানি উন্নয়নের মূল করণীয় হিসেবে গ্রহণ করেন।
এ রকম লক্ষ্যে বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের ওপর ‘বেষ্টনীপন্থা’ আরোপ করেন, যার অধীন নদ-নদীর তীরের বরাবর বেড়িবাঁধ তথা বেষ্টনী নির্মাণ করে প্লাবন ভূমিকে নদী খাত থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়।
বাংলাদেশ প্রায় ৭০ বছর ধরে এই বেষ্টনীপন্থা অনুসরণ করেছে এবং হাজার হাজার মাইল বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে হাজার হাজার স্লুইসগেট।
এসবের সার্বিক ফলাফল—বাংলাদেশের নদীব্যবস্থার চরম অবক্ষয়। শুধু তা-ই নয়, বেষ্টনীপন্থা ডেকে এনেছে এক নতুন সমস্যা এবং সেটা হলো জলাবদ্ধতা। শহর ও গ্রাম—বাংলাদেশের সর্বত্র এখন জলাবদ্ধতা ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে।
৪.
বাংলাদেশের এই ভ্রান্ত ধারার পানি উন্নয়নের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো বড়াল নদের অভিজ্ঞতা। উত্তরবঙ্গের এই প্রসিদ্ধ নদ রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে গোটা চলনবিল এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হুরসাগর নদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাঘাবাড়ির কাছে যমুনার সঙ্গে মিশেছে।
এই নদ একদা চলনবিলকে বিশাল প্রাকৃতিক পানি সংরক্ষণাগার হিসেবে ব্যবহার করে পদ্মা ও যমুনার পানির উচ্চতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করত এবং বন্যা প্রশমনে সহায়তা করত।
আশির দশকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বড়াল নদ-সৃষ্ট বন্যা প্রতিরোধের নামে চারঘাটে বড়ালে প্রবেশকারী পদ্মার পানির পরিমাণ হ্রাসের লক্ষ্যে একটি তিন কপাটবিশিষ্ট স্লুইসগেট স্থাপন করে।
এই স্লুইসগেটের মোট প্রস্থ ছিল আনুমানিক ১৫ ফুট, অথচ আদি (সিএস) ভূমি জরিপ অনুসারে চারঘাটে বড়ালের প্রশস্ততা ছিল প্রায় ৫০০ ফুট। কাজেই পদ্মার পানি বড়ালে প্রবেশের জন্য পাউবো নির্মিত স্লুইসগেট যে পর্যাপ্ত ছিল না, তা বলাই বাহুল্য।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নদী দখল
- নদী দূষণ
- নাব্যতা সংকট
- মৃতপ্রায়