নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছেন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রায় চল্লিশ হাজার বডি ক্যামেরা ব্যবহার হবে। যুক্তি হলো, এতে প্রিজাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটগ্রহণকারীদের কার্যক্রম রেকর্ড থাকবে, অনিয়ম কমবে, স্বচ্ছতা বাড়বে। প্রযুক্তির এই অগ্রগতি কাগজে-কলমে প্রশংসনীয়, কিন্তু প্রশ্ন হলো বডি ক্যামেরা কি সত্যিই মন ক্যামেরা-র অভাব পূরণ করতে পারবে?
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আসল শক্তি হলো মানুষের নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও সাহস। ক্যামেরা যতই উন্নত হোক, যদি মন সৎ না হয়, তবে ফুটেজ কেবল ঘটনার প্রমাণ হয়ে পরে দেখা যাবে, কিন্তু ঘটনার প্রতিরোধ হবে না। অতীতে দেখা গেছে, বিভিন্ন নির্বাচনে সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক বা সাধারণ মানুষের ক্যামেরায় অনিয়ম ধরা পড়লেও বিচার হয়নি, দায়ীদের শাস্তি হয়নি। বরং অনেক সময় ফুটেজই হারিয়ে গেছে বা অপ্রাসঙ্গিক বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে শুধু প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে কি গণতন্ত্রের আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব?
বডি ক্যামেরা মূলত একটি যান্ত্রিক চোখ। এটি যা দেখে তাই রেকর্ড করে। কিন্তু নির্বাচনকালে অসংখ্য ঘটনা ঘটে ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে চাপ, ভয়ভীতি, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে হামলা, বা আগেই ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা। এসব ধরা পড়ে না। মন ক্যামেরা—মানে অন্তরের সততা ও ন্যায়বোধ থাকলেই কেবল একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, একজন পুলিশ সদস্য, কিংবা একজন ভোটগ্রহণকারী সাহস করে অনিয়ম প্রতিরোধে দাঁড়াতে পারেন।
এখানে আরেকটি বাস্তবতা আছে তা হলো প্রযুক্তির অপব্যবহার। যদি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে একই কর্তৃপক্ষের হাতে, তবে তা প্রমাণ গোপনের হাতিয়ারও হতে পারে। বডি ক্যামেরা চালু হলো বটে, কিন্তু যদি রেকর্ড বন্ধ করে দেওয়া যায় ইচ্ছেমতো, বা সংরক্ষিত ফুটেজ প্রকাশ না করা হয় তবে পুরো প্রকল্পের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
আসলে গণতান্ত্রিক শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দ্বিমুখী উদ্যোগ, প্রযুক্তিগত স্বচ্ছতা ও মানবিক সততা। প্রথমটি কেনা যায়, দ্বিতীয়টি গড়ে তুলতে হয়। বডি ক্যামেরা কেনার জন্য বাজেট বরাদ্দ হয় একবারে, কিন্তু মন ক্যামেরা তৈরি করতে ধারাবাহিক শিক্ষা, জবাবদিহিতা, আইনের শাসন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।
মানবসভ্যতার বিবর্তন শুধু প্রযুক্তি, স্থাপত্য কিংবা বিজ্ঞানেই ঘটেনি। এর গভীরে রয়েছে আস্থা ও অবিশ্বাসের লড়াই। ইতিহাসে যতই পেছনে যাওয়া যায়, দেখা যায়, নিরাপত্তার প্রয়োজনে মানুষ নতুন নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে; কিন্তু এর উৎস প্রায় সব সময়ই একই ভয় এবং সন্দেহ।