গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘দি রিপাবলিক’। এটি বিশ্বে বহুল পঠিত একটি গ্রন্থ। এ গ্রন্থে প্লেটোর মূল দর্শনের উল্লেখ আছে। প্লেটো একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা এবং এর রূপরেখা অঙ্কন করেছেন। সেই কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেখানে দুটি শ্রেণি থাকবে। এর একটি হচ্ছে, গার্ডিয়ান ক্লাস এবং অন্যটি আর্টিজ্যান ক্লাস। গার্ডিয়ান ক্লাস হচ্ছে শাসক ও যোদ্ধা; এরা অভিভাবক শ্রেণির অন্তর্গত। অবশিষ্ট সবাই যেমন-কৃষক, শ্রমিক, কারিগর-এরা আর্টিজ্যান শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
প্লেটো যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, সে রাষ্ট্রে গার্ডিয়ান শ্রেণির কোনো পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না। তার যুক্তি ছিল, পরিবার ও সম্পত্তি না থাকলে শাসকশ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত ও অসৎ হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। পরিবার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রতি মোহ ও পিছুটান না থাকলে শাসকশ্রেণি রাষ্ট্রপরিচালনায় গভীরভাবে মনোযোগী হতে পারবে। তারা সর্বতোভাবেই পরিবার ও সম্পদের মোহমুক্ত থেকে রাষ্ট্রপরিচালনা করবে। মূলত এ কারণেই গার্ডিয়ান বা অভিভাবক শ্রেণির জন্য তিনি পরিবার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিষিদ্ধের কথা বলেছিলেন। অভিভাবক শ্রেণি ব্যারাকে বসবাস করবে এবং তাদের পরিবারের বদলে একদল স্ত্রী থাকবে-যাদের বলা হবে কমিউনিটি অব ওয়াইভস। এর ফলে অভিভাবক শ্রেণি যে সন্তানসন্ততির জন্ম দেবে, তাদের কোনো নির্দিষ্ট পিতৃত্ব পরিচয় থাকবে না। এটা করা হলে কোন পিতার কোন সন্তান, তা চিহ্নিত করা সম্ভব হবে না। ফলে গার্ডিয়ান শ্রেণির কোনো পিতার সন্তানের প্রতি দুর্বলতা ও পক্ষপাত থাকবে না। সন্তান ও পরিবারের প্রতি মোহ শাসকশ্রেণিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে। ব্যক্তি মানুষ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়লে সে তখন নিরপেক্ষভাবে রাষ্ট্রের কাজ সম্পন্ন করতে পারে না।
প্লেটোর মতে, শাসকশ্রেণিকে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে মোহমুক্ত রাখতে হবে। তাহলে শাসকরা জনকল্যাণে অধিকতর মনোযোগী হতে পারবেন। তিনি ন্যায়পরায়ণ এবং সবার প্রতি ন্যায্যতার ভিত্তিতে যৌক্তিক আচরণ করতে পারবেন। তবে আর্টিজ্যান শ্রেণির পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে। তাদের প্রধান কাজ হবে উৎপাদন এবং সে কাজেই তারা আত্মনিয়োগ করবেন। এ ব্যবস্থাকেই বলা হয় প্লেটোর সাম্যবাদ; মার্কসের সাম্যবাদের সঙ্গে তুলনা করে একে বলা হয় হাফ কমিউনিজম।
প্লেটোর দর্শনের মূল ভিত্তি হচ্ছে তার ন্যায়বিচারের ধারণা। রাষ্ট্র সবার প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে, এটি তার দর্শনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের যথাযথ পাওনা নিশ্চিত করতে হবে : To give everyman his due is Plato's justice। এ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই তার আদর্শ রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে। ন্যায়সংগত অধিকারপ্রাপ্তি শুধু বিচারের ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রেই একজন নাগরিকের ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। অধিকারবঞ্চিত মানুষ একসময় বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে।
প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রের শাসক হবেন দার্শনিক রাজা (philosopher king)। তখন যেহেতু রাজতন্ত্র ছিল, তাই তিনি রাজার কথাই বলেছেন। রাজতন্ত্রে রাজাই শাসক। কিন্তু এর গূঢ় অর্থ হলো, শাসককে হতে হবে শিক্ষিত-তথা সুশিক্ষিত, তথা জ্ঞানী। প্রাজ্ঞ শাসকের কথাই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন। একজন দার্শনিক তথা জ্ঞানী শাসক হয় মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ও ন্যায়পরায়ণ। ব্যক্তিগত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি দেশের মানুষের কল্যাণ সাধনে ব্যাপৃত থাকেন। শাসক যদি সৎ এবং ভালো গুণাবলিসম্পন্ন হন, তাহলে তার সুফল পুরো জাতি ভোগ করে। আর শাসক যদি অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত হন, তাহলে সেই জাতির দুর্ভোগের সীমা থাকে না। কোনো রাষ্ট্রে যদি দার্শনিক রাজা অর্থাৎ সুশিক্ষিত শাসকের শাসন কায়েম থাকে, তাহলে সেই রাষ্ট্রে দুর্নীতি-অনিয়মের আশঙ্কা কম থাকবে। সেই রাষ্ট্রের নাগরিক ও সম্পদ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ থাকবে।
প্লেটোর চিন্তা ও দর্শনের মূলে ছিল তার শিক্ষক মহামতি সক্রেটিসের করুণ পরিণতি। সক্রেটিস ছিলেন মহাজ্ঞানী দার্শনিক। শাসকশ্রেণি সক্রেটিসকে বিষপানে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মৃত্যুর আগে হেমলক বিষের পাত্র হাতে নিয়ে শাসকদের উদ্দেশে সক্রেটিস যে বক্তব্য প্রদান করেছিলেন, তা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘I to die, you to live, which is better only god knows’. প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে শাসকরা সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছিল, পৃথিবীর মানুষ তাদের মনে রাখেনি। কিন্তু সক্রেটিসের নাম এখনো পৃথিবীব্যাপী শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। পৃথিবী যতদিন থাকবে, সক্রেটিস ঠিক ততদিন মানুষের হৃদয়ে জাগরূক থাকবেন। সক্রেটিস তার অর্জিত জ্ঞান তরুণ সমাজের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এটা অশিক্ষিত শাসকদের কাছে ভালো লাগেনি। তারা জ্ঞান দিয়ে সক্রেটিসকে মোকাবিলা করতে না পেরে তাকে হত্যা করে আপদ বিদায় করতে চেয়েছিলেন। সক্রেটিস বুঝতে পেরেছিলেন, যদি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের অধিকার সুরক্ষিত হবে। তারা শোষণের শিকার হবে না। কিন্তু তার এ প্রচারণা ছিল প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থার প্রতিকূলে। তাই তিনি শাসকশ্রেণির রোষানলে পতিত হন। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘knowledge is virtue’ অর্থাৎ জ্ঞানই সৎগুণ। সক্রেটিসের একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘know thyself’, অর্থাৎ নিজেকে জানো বা নিজেকে চেনো। তিনি মানবজাতির উদ্দেশে এ উক্তি করেছিলেন। অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজেকে বুঝতে চেষ্টা করা। নিজের ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করতে শেখা একজন মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তৎকালীন গ্রিক সমাজ সক্রেটিসের এ বক্তব্য সহ্য করতে পারেনি। তারা মনে করেছিল, সক্রেটিস সম্ভবত তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে; তাই শাসকগোষ্ঠী বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। সক্রেটিসের এ নির্মম হত্যাকাণ্ডে প্লেটো নিদারুণভাবে শোকাহত ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে বারবার উল্লেখ করেছেন, যারা সক্রেটিসকে হত্যা করেছেন, তারা ক্ষমার অযোগ্য। সেই বোধ থেকেই প্লেটো বলেছিলেন, রাষ্ট্রের শাসককে হতে হবে দার্শনিক এবং মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন। একমাত্র দার্শনিক রাজার পক্ষেই প্রজাদের সব সমস্যা অনুধাবন ও সমাধান করা সম্ভব।